দেশের আলোচিত-সমালোচিত শীর্ষ স্থানীয় শিল্পগ্রুপ এস আলমের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের মা চেমন আরা বেগম (৯৫) আর নেই (ইন্নাল্লিাহে…রাজেউন)। দেশের আলোচিত এ শিল্পপতি দেশে না থাকায় মায়ের শেষ দিনগুলোতেও পাশেও থাকতে পারেননি।
সাইফুল আলম মাসুদ দেশে-বিদেশে এস আলম নামেই পরিচিত। তার মা চেমন আরা বেগম আজ রোববার ভোরে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। এস আলমসহ ৬ ছেলে আর ৫ মেয়ের জননী তিনি। তার বড় ছেলে মোরশেদুল আলম ২০২০ সালে মারা গেছেন করোনায়।
এস আলমের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, চেমন আরা বেগমের মরদেহ ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামের পটিয়ায় নিজ বাড়িতে আনা হয়েছিল। বাদ আছরের পর পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে পৌরসভার এস আলম জামে মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

এদিকে, গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের পূর্বেই এস আলম স্বপরিবারে দেশ ত্যাগ করেন। স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে আছেন। মূলত, এর পরই একের পর এক বেরিয়ে আসে ব্যাংক খাতে ব্যাপক দুর্নীতির খবর। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে পরিবারটি। ফলে দুর্নীতি জটিলতায় গ্রেফতার এড়াতে দেশে ফিরে মায়ের শেষ বিদায়েও অংশ নিতে পারেননি সাইফুল আলম মাসুদেরসহ অন্য ভাইদের পরিবারও।
জানাযায় অংশ নেওয়া প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, জানাযায় সাইফুল আলম মাসুদ কিংবা তার ভাইদের কাউকে দেখা যায়নি। আত্মীয়স্বজন এবং এলাকাবাসীর সহযোগিতায় দাফন সম্পন্ন হয়।
ইস্পাত, চিনি, ভোজ্যতেল, ভোগ্যপণ্য, পরিবহন, আবাসন, সিমেন্ট খাত, শিপিং, বিদ্যুৎ এবং আর্থিক খাতে ছড়িয়ে আছে দেশের এই শীর্ষ শিল্পগ্রুপের ব্যবসা। তবে ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থ পাচার ও ব্যাংক দখলে অভিযুক্ত এস আলম গ্রুপ।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে, তাদের অন্যতম এস আলম গ্রুপ। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গত এক দশকে এস আলম গ্রুপ রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রশ্রয় পাওয়ার সমালোচনা রয়েছে।

১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে এস আলম
এস আলম ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণসহ বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে সিআইডি।
গত ৩১ আগস্ট সিআইডির পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে এস আলমসহ সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করে একদিনের ব্যবধানে আবার বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের (পিআর) অনুমতি গ্রহণ করেছেন। তারা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাস ও ইউরোপে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে নিজের ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ করেছেন।
সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, এস আলমের পাচার করা অর্থে সিঙ্গাপুরে ২ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার পরিশোধিত মূলধনের ক্যানালি লজিস্টিক প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান করেছেন এস আলম ও তার সহযোগী ব্যক্তিরা। তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিদেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগের নামে ছয়টি ব্যাংক থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে এস আলম অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১৮ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ আনা হয়েছে।
সিআইডি বলছে, এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন, ছেলে আহসানুল আলম, আশরাফুল আলমসহ তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং অপরাধ করেছেন তাঁরা।
এস আলমের পিএস আকিজের প্রতিষ্ঠানের হিসাবেই মিলল ৯৯ কোটি
মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদের (এস আলম) পিএস আকিজ উদ্দিনের চার প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৯৯ কোটি টাকার হদিস পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)।
গত ২৮ আগস্ট সকালে আকিজ উদ্দিনের চার প্রতিষ্ঠানে ৯৯ কোটি টাকা মেলার খবরটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়। এদিন বিকেলেই ৩০ দিনের জন্য চার প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবসহ তার ব্যক্তিগত হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
মেয়ের জামাইসহ এস আলমের বিরুদ্ধে মামলা
আগ্নেয়াস্ত্র এবং দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগে এস আলম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল আলম মাসুদ ও তার মেয়ের জামাই বেলাল আহমেদসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি লোকাল অফিসের গোডাউন গার্ড মো. সফিউল্লাহ (৫৮) বাদি হয়ে রাজধানীর মতিঝিল থানায় এই মামলা দায়ের করেন।
মামলার বাকি আসামিরা হলেন- ব্যাংকটির সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মাসুদের পিএস আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিন ও মোহাম্মদ সাব্বির, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী ও জে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, এম শহিদুল, জাফর আলম, নেয়ামত উল্লাহকে আসামি করা হয়েছে।
এস আলমের দু’ছেলেসহ সহযোগীর অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্তের আবেদন
এস আলমের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলমের দুই ছেলে আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম মাহির এবং তাদের অন্যতম সহযোগী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য সৈয়দ আবু মো. দাউদের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্তের আবেদন করা হয়েছে। আবেদনে তাদের জ্ঞাত আয়বর্হিভূত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে বলা হয়েছে।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর দুদকের চেয়ারম্যান বরাবর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. সুলতান মাহমুদ এ আবেদন দায়ের করেন।
আবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিকভাবে মোহাম্মদ সাইফুল আলমের (এস আলম) দুই পুত্র আশরাফুল আলম, আসাদুল আলম মাহির নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর অবৈধভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বর্হিভূত ৫০০ কোটি কালো টাকা সাদা করেন। তাদের সহযোগিতা করেন সৈয়দ আবু মো. দাউদ, সদস্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (সাবেক কর কমিশনার, চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-১)।
সৈয়দ আবু মো. দাউদ অবৈধভাবে কোটি টাকা গ্রহণ করে ১২৫ কোটি টাকার স্থলে নামে মাত্র ৫০ কোটি টাকা আয়কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করেন। যা সম্পূর্ণরূপে আইন বর্হিভূত এবং অবৈধ। অবৈধভাবে জ্ঞাত আয় বর্হিভূত অর্থ অর্জন করায় সৈয়দ আবু মো. দাউদ, আশরাফুল আলম, আসাদুল আলম মাহিরদের বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭ ধারায় মামলা দায়ের করে জ্ঞাত আয়বর্হিভূত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করা হয়।
পরিবারেরসহ দেশে-বিদেশে থাকা এস আলমের সব সম্পত্তির তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
এস আলমের দেশে-বিদেশে থাকা সম্পত্তির সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পত্তিও তালিকায় দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লা ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে আইন সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
একইসঙ্গে বিদেশে থাকা এস আলম গ্রুপের সম্পদ ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. রুকুনুজ্জামান।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর এস আলম গ্রুপ এবং প্রতিষ্ঠানটির সব সম্পত্তি স্থানান্তর বা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে রিট দায়ের করা হয়। রিটে এস আলম গ্রুপ এবং প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সব স্থাবর সম্পত্তির তালিকা দাখিল করার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. রুকুনুজ্জামান এ রিট দায়ের করেন।
এর আগে, ১১ সেপ্টেম্বর ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এস আলম গ্রুপ, এর শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও অন্যান্য ব্যবসাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গ্রহণ করা মোট ঋণের পরিমাণ, বর্তমান অবস্থা এবং দায়সহ কয়েকটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে ও ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর আইনি নোটিশ পাঠান রিট আবেদনকারী আইনজীবী।
এস আলমের সম্পত্তি বিক্রি করে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক
মোহাম্মদ সাইফুল আলমের (এস আলম) প্রতিষ্ঠিত এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ৬টি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া টাকার বিদেশে পাচার করার অভিযোগ আছে।
এদিকে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কথা বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বিদেশে পাচার করা টাকা উদ্ধার করতে না পারলে এস আলমের জমিসহ সম্পত্তি বিক্রি করে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
গত ২৮ আগস্ট দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
এস আলমের জমিসহ সম্পত্তি না কেনোর আহ্বান জানিয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের স্বার্থে যেন কেউ না হাত দেন। এসব সম্পত্তি বিক্রি করে আমরা আমানতকারীকে টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করবো।