১৯শে জুন, ২০২৫

প্রেস দোকানের কর্মচারী থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি, পরিচয় দেন বিরাট ‘সাংবাদিক’

চান্দগাঁওয়ে কথিত ‘সাংবাদিক’ কাজী নিজামের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ অটোটেম্পু চালকরা, আছে ঋণখেলাপীসহ ৪ মামলা

শেয়ার করুন

চান্দগাঁওয়ের শীর্ষ চাঁদাবাজ আবুল বশরকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর পর আলোচনায় উঠে এসেছে আরেক চাঁদাবাজ কাজী নিজাম উদ্দীনের নাম। কাজী নিজাম উদ্দীন-আবুল বশর চান্দগাঁও-বোলখালী এলাকায় গুরু-শীর্ষ এবং চাঁদাবাজ তৈরির কারিগর হিসেবে পরিচিত।

কাজী নিজাম উদ্দীন কর্মজীবনের শুরুতে প্রেস দোকানের কর্মচারী ছিলেন, পরে বিভিন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু, নিজেকে পরিচয় দেন বিরাট সাংবাদিক। পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত মো. জয়নাল নামের এক ব্যক্তির সহযোগিতায় নগরীর চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল, সিএন্ডবি, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, কালুরঘাট এবং বোয়ালখালী এলাকায় পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন। গড়ে তুলেছেন বিশাল এক চাঁদাবাজীর সাম্রাজ্য। আর সেই সাম্রাজ্য দেখাশোনা করেন আরও ৮/১০ জন চাঁদাবাজ। এরা মূলত অটোটেম্পু চালক। এখানেই থেমে নেই তার অপরাধের ফিরিস্তি, তার বিরুদ্ধে আছে নারী-নির্যাতন ও ঋণখেলাপীর ৪ মামলা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মামলায় বেশ কয়েকবার জেলও খেটেছেন। বিভিন্ন সময় নিজেকে সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি এবং পুলিশ পরিচয় দিয়ে বহু মানুষকে ভয়ভীতি দেখানোর সুনির্দিষ্ট অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, কাজী নিজাম উদ্দীন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মধ্যম শাকপুরার মৃত আব্দুল মাবুদের পুত্র। পরিবারের আর্থিক অনটনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লার প্রেস বাজারের একটি স্কিন প্রিন্ট দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এখানে বেশ কয়েক বছর কাজ করার সুবাধে বিভিন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত হন। সখ্যতা গড়ে উঠে পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত আরেক চাঁদাবাজ মো. জয়নালের সঙ্গে। তারই সহযোগিতায় আরও ৮/১০ জনকে সঙ্গে নিয়ে চান্দগাঁওয়ের বাস টার্মিনাল, সিএন্ডবি, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, কালুরঘাট এবং বোয়ালখালী এলাকায় পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন। বোয়ালখালীর কানুনগো পাড়া, সিইও অফিস, ফুলতলা, শাকপুরা মিলিটারি পোল থেকে কালুরঘাট সেতু হয়ে কাপ্তাই রাস্তার মাথা অটোটেম্পু লাইনে চলা অন্তত অর্ধশতাধিক অবৈধ গাড়ি থেকে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা মাসিক চাঁদা আদায় করেন। চাঁদা না দিলে ট্রাফিক পুলিশকে দিয়ে হয়রানিসহ মামলার নামে মোটা অংকের টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ আছে। এই কাজে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন কাজী নিজাম উদ্দীনের প্রধান সহযোগী আবুল বশর (প্রকাশ বশর)। তিনি বর্তমানে চাঁদাচাজী মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। আর আবুল বশরের হয়ে কাজ করেন জাহেদ, ইয়াছিন, জিসাদ, তৌহিদসহ অন্তত ৮/১০ জন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অটোটেম্পু চালক বলেন, কাজী নিজামের নৈরাজ্যে আমরা অতিষ্ঠ। তার অন্যান্য সহযোগীরা এতটাই বেপরোয়া যে তাদের কারণে আমাদের গাড়ি চালানোটাই এখন দায় হয়ে গেছে। তারা টাকা ছাড়া কিছুই বুঝে না। টাকা না দিলে নানা রকম হয়রানি করে। পুলিশকে দিয়ে গাড়ি ধরে নিয়ে যায়। মোটা অংকের জরিমানা করে।

সম্প্রতি কাজী নিজাম উদ্দীনের চাঁদাবাজি থেকে রক্ষা পেতে এবং তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পুলিশ কমিশনার বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন এক চালক।

নাম গোপন রাখা শর্তে সেই চালক বলেন, চক্রটি অনেক ভয়ঙ্কর। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। কথা বললেই গাড়ি নিয়ে বের হওয়া যায় না রাস্তায়। পুলিশকে ব্যবহার করে গাড়ি টু করে দেয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানা পুলিশ জানিয়েছেন, চান্দগাঁও বা রাস্তার মাথা এলাকায় এখন কোনো ধরনের চাঁদাবাজি চলছে না। দুই দিন আগে সেখানে অভিযান চালানো হয়েছে। অনেকগুলো অবৈধ সিএনজি এবং অটোটেম্পু আটক করা হয়েছে। এরপরও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্রে জানা গেছে, কথিত ভুয়া সাংবাদিক কাজী নিজাম উদ্দীনের বিরুদ্ধে ঋণখেলাপী এবং নারী নির্যাতনের অন্তত ৪টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ঋণখেলাপীর দুইটি মামলায় এবং নারী নির্যাতনের একটি মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি। যদিও ঋণখেলাপী এবং নারী নির্যাতনের মামলায় তিনি আগেও জেল খেটেছেন।

সোনালী ব্যাংক নজির আহমদ রোড শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে ‘টিএন প্রসেস’ নামের একটি নামসর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে। ওই বছরের ৬ আগস্ট সোনালী ব্যাংকের উক্ত শাখা থেকে ৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে উধাও হয়ে যান। ঋণের টাকা না পেয়ে ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর অর্থ ঋণ আদালতে ঋণখেলাপীর মামলা দায়ের করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ (মামলা নং- ১৫৯/১২)। পরে আদালতের নির্দেশে কাজী নিজাম উদ্দীনকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। মাসখানেক জেল হাজতে থেকে পুরো টাকা পরিশোধ করবেন বলে জামিনে বের হয়েই ফেরারী হয়ে যান। এরপর ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জারী মামলা রুজু করেন (মামলা নং- ৫/২০১৪)। ঋণখেলাপীর ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি হয়েও অদৃশ্য ক্ষমতায় প্রকাশ্য দিবালোকে চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছেন।

সূত্রে আরও জানা যায়, কাজী নিজাম উদ্দীন প্রথম স্ত্রীর নারী নির্যাতন এবং যৌতুকের মামলাও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বোয়ালখালী থানার অফিসার ইনচার্জ গোলাম সারোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, বিষয়টি সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অবগত নই। আমি জেনে আপনাকে বিস্তারিত জানাতে পারব।

এদিকে, চান্দগাঁওয়ে চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেফতারের পর কারাগারে প্রেরণ করা আবুল বশরকে ছাড়িয়ে নিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে চক্রটির বিরুদ্ধে। বাদী লোকমানকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং সাবেক এক জনপ্রতিনিধির নাম ভাঙিয়ে মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করেন।

গত ১১ মে (রোববার) চান্দগাঁও থানায় চারজনের নাম উল্লেখ করে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। দায়ের করা অভিযোগে বাদী চারজনকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন- তারা হলেন কথিত সাংবাদিক কাজী নিজাম উদ্দীন, মেজবাহ উদ্দীন, রুমি আক্তার ও আলমগীর।

অভিযোগে বলা হয়, কাজী নিজাম উদ্দীন নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সরাসরি বাদী লোকমানকে ফোন করে মামলা তুলে নিতে বলেন। তিনি নিজেকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. ফয়সাল এবং স্থানীয় কাউন্সিলর আজম খানের পরিচয় দিয়ে কথা বলেন, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও প্রতারণামূলক।

লোকমান বলেন, ‘প্রথমে সাংবাদিক পরিচয়ে যোগাযোগ করে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। পরে হুমকির সুরে বলা হয়, মামলা না তুললে জীবন নিয়ে বিপদে পড়তে হবে। এক পর্যায়ে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়।’

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, চাঁদাবাজ আবুল বশরের পক্ষে থেকে একদল লোক পুলিশ এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে মামলাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। যারা মামলায় বাদী ও পুলিশকে সহযোগিতা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পর বশরের বড় ভাই পরিচয়দানকারী কাজী নিজাম উদ্দীন এবং মো. জয়নাল পুলিশের সঙ্গে দেনদরবার করে বশরকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে পুলিশ কোনো আপস না করে আবুল বশরকে আদালতে সোপর্দ করে।

এদিকে কাজী নিজাম ও তার সহযোগীরা- মো. জাহেদ, মো. ইয়াছিন, জিসাদ ও তৌহিদ মিলে বাদী পক্ষকে বশরের স্ত্রীসহ বিভিন্ন জনের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিঃ দ্রঃ চাঁদাবাজ কাজী নিজাম উদ্দীনের খুঁটির জোর পুলিশের সোর্স খ্যাত মো. জয়নালকে নিয়ে প্রতিবেদন আসছে খুব শিগগির।

বিস্তারিত পড়ুন : চাঁদাবাজির মামলা তুলে নিতে বাদীকে চাপ, ‘কথিত’ সাংবাদিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে থানায় জিডি
বিস্তারিত পড়ুন : চান্দগাঁওয়ের শীর্ষ চাঁদাবাজ বশর গ্রেফতারের পর কারাগারে

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন