চট্টগ্রামের মিরসরাই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিম উদ্দিন ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে এক শিক্ষার্থীকে ভিডিও কলে রেখে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসের ভিডিও ধারণ করে পর্নোগ্রাফি তৈরির মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষক আজিম উদ্দিন ভুঁইয়ার পদত্যাগ ও অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসুচী পালন করেছে। এছাড়া, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও তুলেন শিক্ষার্থীরা।
আজ মঙ্গলবার (৩ জুন) সকাল ১০টায় মিরসরাই মিনি স্টেডিয়াম থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়ে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে এসে শেষ হয়। এর আগে মিরসরাই মহাসড়কের পাশে মানববন্ধনের আয়োজন করেন শিক্ষার্থীরা।
মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, প্রধান শিক্ষক আজিম উদ্দিন ভুঁইয়া শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের সাথে সব সময় খারাপ আচরণ করেন। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও ভৎসনা করে বিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেন।

শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির অভিযোগ এনে বলেছেন, বিদ্যালয়ের ঝাড়ু ক্রয় থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক পাখা, লাইট, লাইব্রেরীর বই ক্রয়, বিজ্ঞানাগারের সরঞ্জাম ক্রয়, ডায়েরি ক্রয়, কাগজ, কলম, স্টপলার ও পিন ক্রয় সব কিছুতেই শিক্ষাথীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেন। আবার এসব টাকা বিল বাউচার করে বিদ্যালয়ের কোষাগার থেকে উত্তোলন করে সেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
এছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের প্রতিবন্ধী সাজিয়ে সরকারি একটি স্কীম থেকে বিভিন্ন খাতে ৫ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিজ্ঞানাগার স্থাপন, ভবন উন্নয়ন, লাইব্রেরীর জন্য বই ক্রয়, শিক্ষক প্রনোদনার নামে বিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন সময় উত্তোলন করে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
শিক্ষার্থীদের আরো অভিযোগ, গাইড বইয়ের প্রকাশনা থেকে মোটা অংকের ঘুষ গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের নিন্মমানের বই কিনতে বাধ্য করা তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর অন্যতম।
প্রধান শিক্ষক আজিম উদ্দিন ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে অভিযোগটা হচ্ছে, দিনের বেলায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভিডিও কলে রেখে নিজের স্ত্রীর সাথে পর্নোগ্রাফি তৈরি করে তা শিক্ষর্থীদের মোবাইলে পাঠান। দরিদ্র শিক্ষাথীদের যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেন।
স্থানীয় সংবাদকর্মীদের হাতে আস একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্রধান শিক্ষক আজিম উদ্দিন ভুঁইয়া সম্পূর্ণ উদাম শরীরে এক যুবতীর সাথে যৌন সংগমে লিপ্ত হয়েছেন। ভিডিওর অপর প্রান্তে অজ্ঞাত এক শিক্ষার্থী ছিলেন। সেই শিক্ষার্থী তার মোবাইল থেকে ভিডিওটি স্কিন রেকর্ড করেন। এই ধরেনের ভিডিও তিনি প্রতিনিয়িত করেন এবং ভিডিওতে এক একসময় একেকজন শিক্ষার্থীকে থাকতে বাধ্য করেন।

জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক আজিম উদ্দিন ভুঁইয়ার লালসার শিকার অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে বিদায় নিয়ে অন্যত্র ভর্তি হয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ২০২৩ সালে এসএসপি টেস্ট পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করায় প্রধান শিক্ষক চাঁদনি নামের একটি মেয়েকে অকথ্য ভাষায় গালমন্ধ করেন। ফলে মেয়েটি অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এছাড়া শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট গাইড কিনতে না পারার কারণে গলায় জুতার মালা পরিয়ে হাঁটানোর হুমকিও দেন।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া সানজিদা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি চোখে দেখি কিন্ত স্যার আমাকে অন্ধ দেখিয়ে সরকারি সহায়তার ১২ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। কিন্তু আমি অর্থের অভাবে পড়ালিখা বন্ধ করে দিয়েছি।
ডালিয়া আক্তার নামে আরেক শিক্ষাথী বলেন, আমি কথা বলতে পারি। কিন্তু স্যার আমাকে বাক প্রতিবন্ধী দেখিয়ে আমার নামে টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছেন। আমি বিনা বেতনে অধ্যায়নের আবেদন করলেও স্যার গ্রহণ করেনি।
সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থীর নামে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন ২০২৩ সালে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় মিরসরাই বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিম উদ্দিন ভুঁইয়ার সঙ্গে। এ সময় তিনি ভিডিওটির বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করে সাংবাদিককে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। ভবিষ্যতে এমন ভুল আর হবে না বলেও তিনি আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন।
এ সময় তিনি বলেন, আমি ভুল করেছি, ক্ষমা চাই। আমাকে ক্ষমা করেন দেন।
দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে বলেন, বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় একদিকের তহবিল অন্যদিকে খরচ করেছেন যার বিল-ভাউচার সংরক্ষিত আছে। কিন্তু সুস্থ শিক্ষার্থীদের প্রতিবন্ধী সাজিয়ে সরকারি সহায়তার অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিরসরাই উপজেলা অতিরিক্ত দায়ত্বপ্রাপ্ত উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুস্তফা আলম সরকার বলেন, একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য অভিযোগ খুবই লজ্জার। ওই প্রধান শিক্ষককে আমি বলে দিয়েছি তিনি যেন পদত্যাগ করেন। কারণ তার বিরুদ্ধে যেই পর্নোগ্রাফির অভিযোগ উঠেছে এই অভিযোগের পরে তিনি কোন মুখে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থিত হবেন। একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে ন্যুনতম লজ্জাবোধ থাকা উচিত তার।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলি বলেন, তিনি নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। পর্নোগ্রাফির বিষয়টি কোনোভাবেই মানা যায় না। অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে যাচাই করে দেখব।
চট্টগ্রাম উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ড সচিব প্রফেসর ড.একেএম সামছুদ্দিন আজাদ বলেন, একজন প্রধান শিক্ষকের নৈতিক চিরিত্রের এমন অধপতন হলে বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মতো স্পর্শকাতর স্থানে তাকে রাখা কোনো প্রকারেই সমিচিন নয়। তবে অফিসিয়ালি সিদ্ধান্ত উপজেলা থেকে আসতে হবে। এরপর তথ্য উপাত্তের সত্যতা পেলে ওই প্রধান শিক্ষককে অব্যাহতির পাশাপাশি শাস্তির সম্মুখিন হতে হবে।