চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ নেওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে আজ চেয়ারে বসেছেন ডা. শাহাদাত হোসেন। আর চেয়ারে বসেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে হুঁশিয়ারি করে বলেছেন, আমি এসি রুমে বসে থাকার লোক নই, স্পটে যাব, গিয়ে যদি কাউকে না পাই তাহলে চাকরি থাকবে।
এদিকে, বিএনপি থেকে মেয়র হওয়া শাহাদাতও নগর সরকার ব্যবস্থায় আস্থা রেখেছেন। তিনি মনে করেন, নগর সরকার যদি প্রতিষ্ঠা হয় তাহলে সমস্ত সেবাদানকারী সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আনা যাবে।
আজ মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) বিকেলে নগরীর লালদিঘীর পাড়ে চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সম্মেলন কক্ষে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তিনি নগরীর টাইগারপাসে চসিকের অস্থায়ী কার্যালয়ে যান।

এদিন তিনি চট্টগ্রাম শহরকে ‘গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি এবং হেলদি সিটি’ হিসেবে গড়ে তুলতে বেশ কিছু বিষয়ে লক্ষ্যস্থির করে কাজ শুরু করার কথা জানান।
কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের শুরুতে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের অবদান এবং অবদান রাখা সব শ্রেণির যোদ্ধা-শহীদ স্মরণ করেন, স্মরণ করেন নতুন বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন এবং শহীদ হওয়া চট্টগ্রামের ছাত্রজনতাকেও।
‘আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে মেয়র পদে এসেছি’
সাড়ে তিন বছর আগে যে নির্বাচনটা হয়েছিল ইভিএমের মাধ্যমে, কিন্তু আমাকে ফলাফল দেয়া হয়েছিল হাতে লিখে। যেখানে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ১০০ ভোট পেয়েছেন, সেটাকে ৩০০ বানিয়ে হাতে লেখা একটা ফলাফল দিয়ে আমাকে পরাজিত দেখানো হয়েছিল। তখন আমি আদালতের কাছে গিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, আমাকে ইভিএমের প্রিন্টেড কপি দেন, আমি গ্রহণ করবো, আমি হাতে লেখা কপি গ্রহণ করবো না। আমি আইনের পথে গিয়েছিলাম, রায় পেয়েছি এবং আজ আপনাদের সামনে আসতে পেরেছি।
‘চট্টগ্রামকে নিয়ে কেন্দ্রী সরকারও ভাবতে হবে’

চট্টগ্রাম ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমন এক জায়গায় আছে, চট্টগ্রাম নিয়ে ভাবার জায়গা শুধু চট্টগ্রাম নয়। এ চিন্তা হতে হবে সারাদেশের ও কেন্দ্রীয় সরকারের। চট্টগ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে- এ স্লোগান দিয়ে আমি কাজ শুরু করবো। চট্টগ্রাম শুধু আমার একার নয়, চট্টগ্রাম সারাদেশের- এ স্লোগান দিয়ে কাজ শুরু করবো। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি, হেলথি সিটি- এটা আমার নির্বাচনী ইশতেহার।
‘আমার রাজনীতি সিটি করপোরেশনের বাইরে’
নগর ভবনকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করে মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, আমি একজন রাজনীতিবিদ। কিন্তু, আমার সকল রাজনীতি থাকবে সিটি কর্পোরেশনের বাইরে। আমি আমার সমস্ত নেতাকর্মীদের বলছি, আপনারা আমাকে কাজের সময় ডিস্টার্ব করবেন না। আমি আপনাদের সঙ্গে রাজনীতি করবো বিকেল পাঁচটার পরে। কিন্তু সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কোনো ধরনের রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা নিয়ে আমার এখানে আসবেন না।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার উদাহরণ টেনে বলেন, ঢাকায় দেখেছি, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা রাত দশটা পর্যন্ত অফিস করেন। ৮৫ বছরের বয়স্ক একজন লোক দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। এত বয়সী একজন লোক যদি এত কষ্ট করতে পারেন, তাহলে আমরা কম বয়সীরা পারবো না কেন। কাজের প্রতি সততা ও সিনসিয়ারিটি থাকতে হবে।
‘ডেঙ্গু প্রতিরোধ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা প্রথম কাজ’
দায়িত্ব নিয়েই ডেঙ্গুকে সংস্থাটির ইমার্জেন্সি ক্রাইসিস উল্লেখ শাহাদাত হোসেন বলেন, মশক নিধনে যে স্প্রে ব্যবহার করা হয় সেটি আমি পরীক্ষা করতে চাই। এমন কোনো স্প্রে আমি চাইনা যে স্প্রে দিলে মশা লাফ দিয়ে উড়ে যাবে। মশা মরছে কি না সেটা দেখতে হবে, না মরলে সে ওষুধ আমি গ্রহণ করবো না।
সভায় প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গণসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধ সেল গঠনের নির্দেশ দেন কর্মকর্তাদের। যেখান থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসহ যাবতীয় খোঁজ খবর নেবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। প্রয়োজনবোধে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সর্বোচ্চ সুচিকিৎসা তদারকি করবেন খোদ মেয়রই।
মেয়র বলেন, ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট সেল সেন্টার চসিকের উদ্যোগে করতে এবং একটা হটলাইন দ্রুতই হবে। যেকোনো জায়গায় কোনো ডেঙ্গু রোগী যদি থাকে কোনো সমস্যায় পড়ে তিনি হটলাইনে কল করবে; আমরা যারা ডাক্তার আছি তারা কাউন্সিলিং করবো।
আরেকটি জিনিস চিন্তা করছি, ৪১ ওয়ার্ডে অভিযান চালাবো। সেখানে যে সচিবরা রয়েছে; তাদের উদ্যোগে সেখানে ডেঙ্গু হেল্প ম্যানেজমেন্ট সেন্টার থাকবে। আমাদের কার্যালয়ে এসে তারা কথা বলতে সেখান থেকে সিরিয়াস রোগীগুলো আমরা সুনির্দিষ্ট হাসপাতালে সেবার ব্যবস্থা করবো। আমাদের মনে রাখতে হবে, যখনই কোনো জরুরি আসে সেটার উপর আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। এখন জরুরি হচ্ছে ‘ডেঙ্গু এবং ক্লিনিং অ্যাকটিভিটিস’। এদিক দিয়ে আমাদের গুরুত্ব দিয়ে ওটার ওপর কাজ করতে হবে।
‘বাড়তি হোল্ডিং ট্যাক্সের দরকার নেই’
আমার হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। যেই হোল্ডিং ট্যাক্স আমরা আগে দিয়ে আসছি, সেই হোল্ডিং ট্যাক্স যদি আমরা ঠিকমতো পাই; ইনশাআল্লাহ চসিকে বেতন দেওয়ার জন্য আর কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না।
আগের হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করতে না পারার কারণ উল্লেখ করে নতুন মেয়র ডা. শাহাদাত বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্সগুলো আমরা নিতে পারছি না বিভিন্ন কারণে। আওয়ামী লীগ সরকারের অনেকেই হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়েছে। আগের যে হোল্ডিং ট্যাক্স দিত সেটাও এখন দিচ্ছে না। আমি জানি অনেকেই দিচ্ছে না। ৩০-৪০ শতাংশ দিচ্ছে না। তাই একটা জায়গায় এসে এগুলো আমাদের শেষ করতে হবে। শেষ করেই যেই জায়গায় হোল্ডিং ট্যাক্স আমরা দিতাম, আপনারা আগে যেটা দিতেন সেটাই একুরেট দেন।
‘রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা সাবধান হয়ে যান’
রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের সাবধান করে ডা. শাহাদাত বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্স আপনারা বিভিন্নভাবে চাচ্ছেন। আমি কিন্তু অনেক কিছু জানি, আমার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান আছে, আমার নিজের হসপিটাল আছে, আমার নিজের বাড়ি আছে; সেখানে কি হয় তার সবকিছু আমি জানি। তাই আপনারা সাবধান হয়ে যান। আমি কিন্তু বলছি সাবধান হয়ে যেতে হবে সবাইকে।
‘৪১ ওয়ার্ডে ৪১টা খেলার মাঠ করতে চাই’
আমাদের পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই। প্রতিটি ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা আমরা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করার চেষ্টা করবো। ৪১টা ওয়ার্ডে ৪১টা খেলার মাঠ করে দেয়ার ইচ্ছা আছে।
এখন শহরের প্রতিটি এলাকায় টার্ফ আছে। কিন্তু, টার্ফে একটা বিশেষ শ্রেণির ছেলেমেয়েরা খেলছে। এতে সমাজে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। কারণ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা সেখানে খেলতে পারছে না।
‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হাসপাতালকে এক নম্বর জয়গায় নিয়ে যেতে চাই’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হাসপাতাল আছে। মেমন হাসপাতাল একসময় প্রসূতিদের জন্য চট্টগ্রামে এক নম্বর হাসপাতাল ছিল। এটাকে আমি আবার এক নম্বর জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।
‘চসিককে পরিবর্তনের জায়াগায় নিয়ে যেতে চাই’
আমি হাঁটবো, সময় দেব। আমি তিনঘণ্টা অফিসে থাকবো, বাকি সময় হাঁটবো। আমি কাজ করতে চাই। চসিককে পরিবর্তনের জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।
‘প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি উদ্ধার করবো’
প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের টাকা দিয়ে কেনা, আপানারা সবাই জানেন। আজ সেটা বেদখল হয়ে গেছে। আমরা যারা রাজনীতি করি, মুখে বড় বড় কথা বলি। কিন্তু ক্ষমতা চলে গেলে বোঝা যায়, অনেককিছু বের হয়ে আসে। এটা আমাদের উদ্ধার করতে হবে। ইনশাল্লাহ, এটা আমি করবো।
‘গত ১৬ বছরে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু মান বৃদ্ধি পায়নি’
চসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫২ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত ১৬ বছর শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু মান বৃদ্ধি পায়নি। অনেক শিক্ষিত যুবককে লেফটেন্যান্ট বানান ইংরেজিতে বলতে বললে পারবে না। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে, এটার কোনো বিকল্প নেই। নৈতিক শিক্ষায় সবাইকে শিক্ষিত করতে হবে। প্রতিটি স্কুলে সেটা করতে হবে। ১৪ ডিসেম্বর আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল। কেন হত্যা করা হয়েছিল ? জাতির মেধাকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য করা হয়েছিল। আমরা একটি মেধাবী জাতি চাই, মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই।
‘নগর সরকার’- এর দাবি ডা. শাহাদাতেরও
ডা. শাহাদাত হোসেন বিশ^াস করেন, নগর সরকার যদি প্রতিষ্ঠা হয় তাহলে সমস্ত সেবাদানকারী সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আনা যাবে। তিনি বলেন, ‘সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করার জন্য নগর সরকার দরকার। নগর সরকার হলে সমস্ত সেবাদানকারী সংস্থাগুলো সিটি করপোরেশনের জনপ্রতিনিধির অধীনে আসবে। এতে কাজের মধ্যে শৃঙ্খলা আসবে। আমি যেসব সেবাদানকারী সংস্থা আছে, তাদের মধ্যে সমন্বয় করবো। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমি সবার সঙ্গে বসতে চাই।
১৯৯৪ সালে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ‘নগর সরকার’ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন আনুষ্ঠানিকভাবে। পরে তার ‘শিষ্য’ সাবেক মেয়র এম মনজুর আলমও মহিউদ্দিন চৌধুরীর ওই ফমূর্লায় একমত হয়ে নগর সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছিলেন।