১৪ই মার্চ, ২০২৫

এস আলমের বাবুর্চির অ্যাকাউন্টে ভোটের আগে রহস্যময় লেনদেন ঘিরে ধুম্রজাল!

শেয়ার করুন

চট্টগ্রামের মুশতাক মিঞা রান্নার কাজ করতেন আলোচিত ব্যবসায়ি এস আলমের ব্যক্তিগত সচিব ও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আকিজ উদ্দিনের বাসায়। ইউনিয়ন ব্যাংকে তার একটি অ্যাকাউন্টকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল ধুম্রজাল। যেখানে নির্বাচনের আগে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছিল। নেওয়া হয়েছিল অর্ধশত কোটি টাকা ঋণ।

আর সেই টাকায় নির্বাচনের খরচ চালাতে বড় অঙ্কের ভাগ পেয়েছেন নবীন-প্রবীণ অনেক নৌকার প্রার্থী ছাড়াও প্রচারণায় অংশ নেওয়া ক্রিকেট তারকা থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেক জনপ্রিয় তারকা। ফলে রহস্যময় অ্যাকাউন্টি থেকে নিজের ভাগের অংশ তুলে ফেলায় ফেঁসে যেতে পারেন তারা। ব্যাংক কর্মকর্তারা মনে করেন, নির্বাচনের খরচ চালাতে তৎকালীন সরকারের পক্ষে এই টাকা বিতরণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সাইফুল আলম মাসুদ (এম আলম)।

সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনের আগে সেই অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ ৭২ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। আর নির্বাচনের পর রহস্যময় কারণে অ্যাকাউন্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আরো জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে (অর্থাৎ, ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর) ইউনিয়ন ব্যাংকের বনানী শাখায় মোস্তাক ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান অ্যাকাউন্টি খুলেছিল। ব্যাংকে থাকা ওই প্রতিষ্ঠানের নথিপত্রে ঢাকার যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, সেখানে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, যার জাতীয় পরিচয় পত্র ব্যবহার করে অ্যাকাউন্টি খোলা হয়েছে তাকে খুঁজে পাওয়া গেছে।

অ্যাকাউন্টির মালিক কে এই মুশতাক মিঞা?

মুশতাক মিঞা চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাজীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এই মোশতাক মিঞা বিতর্কিত ব্যবসায়ী শিল্পগ্রুপ এস আলম গ্রুপে প্রধান সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত সচিব আকিজ উদ্দিনের বাবুর্চি। তিনি আকিজের বাড়িতে রান্নাবান্না এবং দেখাশোনা করেন। আকিজের গ্রামের বাড়ি মুশতাক মিঞার বাড়ির পাশেই।

মুশতাক মিঞা ইউনিয়ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্টি খোলার বিষয়টি স্বীকার করে গণমাধ্যমকে বলেন, চাল-ডালের ব্যবসা করতে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। তবে ব্যবসা করা হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আকিজ স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।

ভুয়া ঠিকানায় প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণা

অ্যাকাউন্টি খোলার জন্য নথিতে যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেটি পুরান ঢাকার বংশালের আগা সাদেক রোডের ৯৬ নম্বর বাড়ি। সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মোস্তাক ট্রেডার্স নামের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। শুধু তাই নয়, গত ২৫ বছরেও ওই ভবনে মোস্তাক ট্রেডার্স নামের কোনো প্রতিষ্ঠানই ছিল না বলে জানিয়েছেন ভবনটিতে থাকা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা।

যত টাকা লেনদেন হয়েছে

ব্যাংক অ্যাকাউন্টি খোলার দিনেই ১৭টি লেনদের মাধ্যমে ২৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা জমা করা হয়। পরের দিন পরপর সাতবারে জমা দেওয়া হয় ১০ কোটি টাকা। পরের মাসের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও কয়েক কোটি টাকা জমা দেওয়া হয়েছিল। ১৭ নভেম্বর একসঙ্গে দুটি চেক বই নেওয়ার জন্য চাহিদাপত্র দিয়ে গ্রাহক টানা এক বছর কোনো লেনদেন করেনি।

এই অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ টাকা উত্তোলন শুরু হয় ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর, যা নির্বাচের মাত্র এক মাসেরও কম সময় আগে। ওই দিন বনানী শাখা থেকে এক চেকে উত্তোলন করা হয় ২ কোটি ৫১ লাখ টাকা ও ১৪ ডিসেম্বর গুলশান শাখা থেকে তোলা হয় ১ কোটি টাকা। এরপর সব টাকা তোলা হয় গুলশান শাখা থেকে। ২৮ ডিসেম্বর তোলা হয় ৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে পৃথক পৃথক চেকে ১০ কোটি, ৬ কোটি ও পাঁচটি চেকে ৫ কোটি টাকা করে মোট ২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি তোলা হয় ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ৭ জানুয়ারি ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরপর ৯ জানুয়ারি পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। আর ওই দিনের পর থেকে অ্যাকাউন্টিতে লেনদেন আর হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৫ আগস্ট পে-অর্ডারের মাধ্যমে হিসাবে থাকা ৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। এরপর ২০ আগস্ট হিসাবটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

যে কারণে খোলা হয় অ্যাকাউন্টি 

সূত্রে জানা যায়, অ্যাকাউন্টির মালিকের পরিচয় যাচাই না করে আকিজ উদ্দিন এবং সাবেক এমডি এবিএম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর নির্দেশে খোলা হয়েছিল। এই অ্যাকাউন্টি পরে নির্বাচনের সময় অর্থ লেনদেনের কাজে ব্যবহার করা হয়।

ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানটি কত টাকা ঋণ নেয়?

ইউনিয়ন ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে মোস্তাক ট্রেডার্সের নামে ২০২২ সালের ডিসেম্বর ও ২০২৩ সালের মার্চে মোট ৫৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল। এখন যার পুরোটাই খেলাপি হয়ে পড়েছে।
ঋণ পরিশোধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাবুর্চি মোহাম্মদ মুশতাকে বলেন, আমি প্রথমে জানতাম না আমার নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে। কিভাবে এত টাকা ঋণ পরিশোধ করবে সেটাও জানি না। আকিজ স্যারকে ফোন করেও পাচ্ছি না।

তবে, স্থানীয়রা জানান, ওই গ্রামের অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে এস আলম। আর এর বিনিময়ে তারা পান মাসিক ভাতা।

মহানগর/এআই

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন