গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ৩টি হত্যাকাণ্ডসহ অসংখ্য চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি-মারামারির ঘটনা ঘটেছে। ৩ জন নিহতের পাশাপাশি আহতের সংখ্যা অন্তত শতাধিক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে ইতোমধ্যে বদলি করা হয়েছে মিরসরাই থানার ওসি আব্দুল কাদেরকে।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হঠাৎ থমকে গেছে উপজেলার ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড। মন্দা চলছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা। এমন নাজুক অবস্থায় মাসব্যাপী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলা আয়োজন দেখে হতাশা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় চট্টগ্রামসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় আয়োজিত বিজয়মেলা কোথাও কোথাও বন্ধ, আবার কোথাও কোথাও ১ দিন, দুইদিন কিংবা সর্বোচ্চ ৬ দিনের অনুমোদন দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রাম শহরের কাজীর দেউড়িতে আয়োজিত মাসব্যাপী বিজয় মেলা এবার মাত্র ৬ দিন হচ্ছে। কিছু উপজেলায় শুধুমাত্র ১৬ ডিসেম্বর একদিন করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

সেখানে মিরসরাই উপজেলায় বিজয় মেলার পরিবর্তে মাসব্যাপী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও জনসাধারণকে অবাক করেছে! বাংলাদেশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি নামের একটি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান এই মেলার আয়োজক। মিরসরাই উপজেলা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই মেলার আয়োজন করছেন সংগঠনটির কথিত সভাপতি এমএম মোশারফ হোসেন মাসুদ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘বাংলাদেশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি’র ব্যানারে মেলার অনুমোদন ও আয়োজন করা হলেও কথিত সভাপতি মোশারফ হোসেন মাসুদ ব্যতীত দেশের কিংবা উপজেলার কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে এই মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়নি। মিরসরাই উপজেলার কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিংবা তাদের পরিবারের কেউও এ মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তাহলে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক, কার কল্যাণে এ মেলার আয়োজন?
এদিকে, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এলো থলের বেড়াল। ‘বাংলাদেশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি’ মূলত মোশারফ হোসেন মাসুদের পারিবারিক ও ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান। নিজের অন্ধত্বকে পুঁজি করে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সংগঠনটির নাম ব্যবহার করে প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে মেলার অনুমোদন নেন। অনুমোদন নেওয়ার পর আয়ত্তের মধ্যে যেখানে প্রভাব খাটাতে পারবেন সেখানে নিজেই মেলার আয়োজন করেন, অন্যথায় বেশিরভাগ মেলা ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকায় তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেন। যদিও একটি মেলার অনুমোদন নিতে তাকে খরচ করতে হয় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা।
সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে স্থানীয় এক গণমাধ্যম কর্মীর সঙ্গে কথা হয় এমএম মোশারফ হোসেন মাসুদের সঙ্গে। ৯ মিনিটের একটি অডিও কল রেকর্ড হাতে আসে মহানগর নিউজের হাতে। সেখানে মাসুদ স্বিকার করে, ‘বাংলাদেশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি’ তার ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
মিরসরাই উপজেলায় আয়োজিত মেলায় স্থানীয় প্রতিবন্ধীদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্ধরা তো দোকান করতে পারবে না, তাদের কিভাবে সম্পৃক্ত করা যাবে?

মেলার আয় থেকে স্থানীয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের আর্থিক সহায়তার দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব সমাজ সেবা কার্যালয়ের কাজ, আমার নয়।
সূত্রে জানা যায়, মিরসরাইয়ে আয়োজিত মেলায় মোট দোকান বরাদ্দ করা হয়েছে ৯৬টি। এছাড়া কিছু অস্থায়ী দোকানসহ শতাধিকের বেশি দোকান থেকে ভাড়া বাবদ তোলা হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
অভিযোগ আছে, মেলার অনুমোদন, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা ও অসাধু সাংবাদিকের পেছনে ব্যয় হয়েছে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। ফলে মিরসরাইয়ের স্থানীয় ব্যবসায়ী, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, মিরসরাইয়ের দুটি প্রেসক্লাবের অর্ধশতাধিক সাংবাদিক ও স্থানীয় জনসাধারণ মেলার বিরোধীতা করলেও কর্ণপাত করছে না মেলার আয়োজন ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। মেলার বিপক্ষে বেশ কয়েকটি আবেদন মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিনের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক ফারিদা খানম বরাবরে প্রেরণ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। বরং অভিযোগকারীদের হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
শুধু অভিযোগকারী নয়, গণমাধ্যম কর্মীদেরও ফোন করে হুমকি দিয়েছে মেলার আয়োজক এমএম মোশারফ হোসেন মাসুদ। এ প্রসঙ্গে গত, ১১ ডিসেম্বর মহানগর নিউজে ‘সাংবাদিককে আইনজীবী আলিফ হত্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং মেলার বিরুদ্ধে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, মিরসরাইয়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করে কোন মেলার প্রয়োজন নেই। এই বিষয়ে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিনের সরকারি নম্বরে কয়েকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
মহানগর নিউজ/এআই