৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫

খুলে দিল কাপ্তাই বাঁধের দেড় ফুট, চাপ নিতে পারবে তো কর্ণফুলী?

রাঙামাটিতে পানি বন্দি ১০ হাজার পরিবার, উৎপাদিত হচ্ছে মৌসুমের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ

ফাইল ছবি

শেয়ার করুন

টানা ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপৎসীমায় পৌঁছে যাওয়ায় ২৫ আগস্ট (রোববার) সকালে ৬ ঘণ্টার জন্য ৬ ইঞ্চি করে ১৬ কপাট খুলে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। এতে পানি নিষ্কাশিত হয়েছে সেকেন্ড ৯ হাজার কিউসিক পানি। পরে দুপুর ২টায় বন্ধ করে সন্ধ্যায় আবার ছাড়া হয়। এরপরও বিপৎসীমার নিচে পানির স্তর না নামায় আজ দুপুরে দেড় ফুট (১৮ ইঞ্চি) খুলে দেয়া হয়েছে। এতে প্রতি সেকেন্ডে ৩০ হাজার কিউসিক পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আরও পাঁচটি ইউনিট চালু রাখায় ২ হাজার কিউসিক পানি বেশি ছাড়া হচ্ছে। ফলে বিশেষজ্ঞ ও জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, জোয়ারের সময় উজানে উঠে আসা বঙ্গোপসাগরের পানি এবং বৃষ্টির পানির সঙ্গে কাপ্তাই হ্রদ থেকে সেকেন্ডে ৩২ হাজার কিউসিক পানির চাপ নিতে পারবে তো হালদা ও কর্ণফুলী নদী?

কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্র জানায়, কাপ্তাই হ্রদের পানি ধারণক্ষমতা এখন একেবারেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। সকাল ১০টায় হ্রদের পানির উচ্চতা ১০৮.৯২  এমএসএল (মিনস সি লেভেল) রেকর্ড করা হয়েছে। যা বিপৎসীমার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ৬ ইঞ্চির জায়গায় ১৮ ইঞ্চি খুলে দেয়া হয়েছে।

বর্ষা আসলেই চট্টগ্রামের মানুষের মনে উঁকি দেয় কখন খুলবে কাপ্তাই হ্রদের বাঁধ। কারণ এ বাঁধের পানি ছাড়লেই ডুবে যায় চট্টগ্রামের ৪ উপজেলা রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালী ও হাটহাজারীর বিস্তীর্ণ জনপদ। এতে পানি বন্দি হয়ে পড়ে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ।

ডুবেছে বোয়ালখালীর বিস্তীর্ণ জনপদ

এদিকে, কয়েক দিনের বৃষ্টিতে অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে হালদার পানি ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজানের বেশ কয়েকটি এলাকায় ঢুকে পড়েছে। প্লাবিত হয়েছে রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালীর নিম্নাঞ্চল। ফলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর সঙ্গে কাপ্তাই হ্রদের পানি যুক্ত হলে নতুন করে প্লাবিত হতে পারে এসব অঞ্চলের অনেক এলাকা।

গত ২৪ আগস্ট নদী গবেষক ড. শফিকুল ইসলাম আশঙ্কা করে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালী ও হাটহাজারী উপজেলার সড়ক, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও পুকুর ডুবে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। কারণ প্রতিদিনই দুই বার করে জোয়ার ভাটা হয় সাগরে। জোয়ারের সময় বঙ্গোপাসাগরের পানি উজানে উঠলে এবং বৃষ্টির পানি ও হ্রদের পানি এক সঙ্গে কর্ণফুলি ও হালদা হয়ে সমুদ্রে নামতে না পারলে পানি উপচে প্লাবিত হতে পারে আশে পাশের এলাকা।

এরই মধ্যে কর্ণফুলী ও হালদার তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালীর নিচু অঞ্চল থেকে একাধিকবার ফোন করে জানতে চাওয়া হচ্ছে ১৮ ইঞ্চি খুলে দেয়ার ব্যাপারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে পূর্বের অভিজ্ঞতা ও মতামত জানাচ্ছেন।

রাঙামাটিতে পানি বন্দি ১০ হাজার পরিবার

কাপ্তাই হ্রদে পানি সর্বোচ্চ বিপৎসীমায় পৌঁছে যাওয়ায় রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ১০ হাজার পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। এর বাইরে দুর্ভোগে পড়েছে লাখো মানুষ।

প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলার লংগদু, জুরাছড়ি উপজেলাসহ কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।

গতকাল সোমবার (২৬ আগস্ট) রাঙামাটির শান্তিনগর, আসামবস্তি, রাঙ্গাপানির লুম্বিনী, হাসপাতাল এলাকা, হ্যাচারি, কৃষি অফিস-সংলগ্ন ট্রাইবেল আদাম, গর্জনতলী, কাঁঠালতলী, কল্যাণপুর, রাজদ্বীপ, ট্রাক টার্মিনালসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হ্রদে পানি বাড়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে লুম্বিনী সড়ক ডুবে গেছে ও আসামবস্তি-ভেভেদী সড়কের আংশিক পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সহকারী শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ ইকরাম উল্লাহ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, বন্যায় জেলার ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠে গেছে। এসব স্কুলে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া ভারী বৃষ্টির কারণে পুরো জেলায় ১০টির অধিক বিদ্যালয়ে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে।

ডুবে গেছে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু

কাপ্তাই হ্রদের পানি সর্বোচ্চ বাড়ায় ডুবে গেছে দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত সেতুও। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সেতুর পাটাতনের ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত পানি উঠেছে। জানা গেছে, পানির চাপে পাটাতনের অনেক স্থানে কাঠ খুলে গেছে। এ কারণে সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল নিষিদ্ধ করেছে পর্যটন কর্তৃপক্ষ।

ডুবে গেছে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু

উৎপাদিত হচ্ছে মৌসুমের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ

বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, হ্রদে পানি বাড়ায় কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন এখন এই মৌসুমের সর্বোচ্চ। সচল রয়েছে কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট। গত ১৯ আগস্ট ছিল ২১৫ মেগাওয়াট। ২৩ আগস্ট ছিল ২১৮ মেগাওয়াট। আজ উৎপাদিত হচ্ছে ২২০ মেগাওয়াট।

কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এ টি এম আবদুজ্জাহের বলেন, ৬ ইঞ্চি করে খুলে দেওয়ার পরও কাপ্তাই হ্রদে পানি বিপৎসীমার নিচে না কমায় বাধ্য হয়ে দেড় ফুট করে ১৬ গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে প্রতি সেকেন্ডে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে ৩০ হাজার কিউসেক। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিট চালু রেখে ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এতে পানি ছাড়া হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ৩২ হাজার কিউসেক পানি।

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন