২২শে এপ্রিল, ২০২৫

আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার, ইসলাম কী বলে?

শেয়ার করুন

আদব, এটি একটি আরবি শব্দ। বাংলা ভাষায় হুবহু ব্যবহৃত ও বহুল প্রচলিত শব্দগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি শব্দ হচ্ছে এটি। যার অর্থ হলো- বিনয়, নম্রতা, সভ্যতা, সুশিক্ষা, মানবিকতা, নৈতিকতা ও শিষ্টাচার ইত্যাদি।

ইবনু হাজার আস-কালানি রহ. ভাষায় কথা ও কাজে প্রশংসনীয় ব্যবহারকে আদব বলে। এক কথায় উত্তম চরিত্র লালন করাকে আদব বলা হয়। আবার আদব কায়দা মানে ভদ্র সমাজে সহাবস্থান, চলা ফেরার নিয়ম নীতি ও রীতি পদ্ধতি।

মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা, পানাহার, বসবাস ও সহাবস্থান সমাজ জীবনের অন্যতম মৌলিক একটি কাজ। প্রাত্যহিক জীবনের কিছু প্রয়োজনীয় ইসলামী শিষ্টাচার নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো —

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা :

পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা শিষ্টাচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলাম মানুষকে সবসময় পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি হয়ে থাকতে শেখায়। যারা পাক পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকার চেষ্টা করে আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারী এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন। সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২২২।

রাসূল (সা.) বলেন, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা হলো ঈমানের অর্ধেক।‍‍‍‍‌‌‌‌‌‌‍ অর্থাৎ আত্মার পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক, আর শারীরিক পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা হলো ঈমানের অর্ধেক উভয়টি মিলে হলো পরিপূর্ণ ঈমান।

পারস্পরিক কথাবার্তায় শিষ্টাচার:

মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে ও নীচু স্বরে কথা বলা উচিত। যখন মানুষের সাথে কথা বলবে নম্রভাবে, হাসিমুখে ও খোলা মনে ভালো ভালো কথা গুলোই বলবে, সে যে ধরণের মানুষই হোক। রাসুলুল্লাহ (সা.) সবসময় মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষের সঙ্গে যে কেউ কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

উচ্চস্বরে কথা বলা, চিৎকার চেঁচামেচি করা, বিকট আওয়াজে হাসা, ও হৈ-হুল্লোড় করা ইত্যাদি কোনো শালীন মানুষের কাজ নয়। নম্রভাবে কথা বলা, গীবত বা চোগলখুরী না করা, মিথ্যা না বলা, কথায় কথায় গালি না দেওয়া ও ভর্ৎসনা না করা, কথা সংক্ষেপ করা, অতিরিক্ত কারো প্রশংসা না করা, নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে কৌতুক করা ইত্যাদি হচ্ছে কথাবার্তায় ইসলামী শিষ্টাচার ও শালীনতার অংশ বিশেষ।

চলাফেরায় শিষ্টাচার:

তোমরা পৃথিবীতে দম্বভরে পদচারণা করো না। চলাফেরায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করো। সুরা-লোকমান : আয়াত: ১৮ – ১৯। অর্থাৎ এমনভাবে দৌড়-ঝাপসহ চলো না যা সভ্যতা ও শালীনতার পরিপন্থী। আল্লাহ তায়ালা বলেন, রহমান এর বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে। সূরা-আল ফুরকান : আয়াত ৬৩। অর্থাৎ তারা গর্বকরে অহংকারীর ন্যায় পা ফেলে না। চলাফেরার মধ্যে নম্রতা অবলম্বন করাই ইসলামি শিষ্টাচার। চলাফেরার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভদ্রতা হচ্ছে নিজের দৃষ্টিকে নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ হতে দূরে রাখা।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে নবী! মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেনো তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং একইভাবে ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারাও যেনো তাদের দৃষ্টিকেও নিম্নগামী করে রাখে। সূরা-আন নূর : আয়াত: ৩০-৩১। চলাফেরার ইসলামি আদব হচ্ছে যে কোন অবস্থায় মুমিন পুরুষ অথবা নারী তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে চলবে, যাতে কোনো নিষিদ্ধ বস্তুর দিকে তাদের দৃষ্টি না যায়।

সালাম বিনিময় করা:

আদব কায়দা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে সবার আগে আসে পারস্পরিক সম্ভাষণের বিষয়টি। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক উত্তম উপায় পরস্পর সালাম আদান-প্রদান। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা সালাম আদান-প্রদানের পদ্ধতি বর্ণনা করে বলেন, যখন তোমাদের অভিবাদন করা হয় (সালাম দেয়া হয়), তখন তোমরাও (উত্তরে) তা অপেক্ষা উত্তম অভিবাদন কর অথবা অনুরূপ কর। সুরা নিসা : আয়াত: ৮৬।

রাসূল (স.) ইরশাদ করেন, কথাবার্তা বলার পূর্বেই সালাম দিবে। তিরমিযী। তাই সালামের ব্যাপারে প্রত্যেক মুসলমানকে অগ্রণী ভূমিকায় থাকতে হবে। কেউ সালাম দিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাঁর সালামের জবাব দিতে হবে। ইসলামে পরিচিত-অপরিচিত, ছোট-বড় সবাইকে সালাম দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বুখারি, হাদিস নং: ১২।

মজলিসের আদব :

মজলিসের আদবের ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে মানুষকে ঠেলে অথবা মানুষের কাঁধের উপর পা দিয়ে সম্মুখে গিয়ে বসতে চেষ্ট না করা, যেখানে খালি পাওয়া যাবে সেখানেই বসা। কোথাও দু’জন লোক বসা থাকলে তাদের অনুমতি নেয়া ব্যতীত দু’জনের মাঝখানে গিয়ে না বসা।

কানে কানে কথা না বলা অর্থাৎ তিনজনের বৈঠকে দু’জনের এমন কানাকানি না করা যাতে তৃতীয়জন কষ্ট পায়। হাঁচির শব্দকে নিচু রাখা, যখন রাসূল (স.) হাঁচি আসতো তখন তিনি নিজের হাত বা কাপড় দ্বারা মুখ ঢেকে ফেলতেন এবং হাঁচির শব্দকে নিচু রাখতেন। আবু দাউদ, হাদিস নং: ৫০২৯।

হাঁচি দেয়ার সময় বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে, যেনো শ্লেষ্মা জাতীয় কোন কিছু আশেপাশের অন্য কোনো লোকের গায়ে-মুখে না পড়ে। হাই তোলার ক্ষেত্রে রাসূল (স.) বলেন, যখন তোমাদের কারো হাই আসে, সে যেনো নিজের হাত মুখের উপর রাখে। মুসলিম।

কারো গৃহে প্রবেশের শিষ্টাচার :

পরিচিত বা অপরিচিত কারো গৃহে প্রবেশের সময় ইসলাম প্রত্যেক মানুষকে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত ঐ গৃহে ঢুকতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, হে ঈমানদারগণ, তােমরা নিজের ঘর ছাড়া অন্য কারো ঘরে সে ঘরের লােকদের অনুমতি ছাড়া ও তাদের সালাম না দিয়ে কখনাে প্রবেশ করাে না, নৈতিকতা ও শালীনতার দিক থেকে এটা তােমাদের জন্যে উত্তম পন্থা। সূরা-আন-নূর : আয়াত ২৭।

লজ্জাশীলতা:

আল্লাহর অপরিসীম দয়া, অনুগ্রহ ও ইহসানের প্রতি মনোযোগী হয়ে নিজের ত্রুটি ও অক্ষমতা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে মানসপটে যে ভাবের উদয় হয়, তাকেই বলা হয় লজ্জাশীলতা।

লাজুকতা মানব চরিত্রের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। গর্হিত ও অশোভন কর্ম পরিহারে এবং উত্তম ও শোভনীয় কার্যাবলী সম্পাদনে লজ্জাশীলতা সহায়ক ভুমিকা পালন করে। বিশেষ করে মানুষকে উত্তম চরিত্রে ভূষিত হওয়ার জন্য লজ্জাশীলতা নিয়ামক হিসাবে কাজ করে।

লজ্জাশীলতা সভ্যতা ও মার্জিত রুচির পরিচায়ক। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন লজ্জাশীলতার মূর্ত প্রতীক। তিনি বলেন, লজ্জাশীলতা ঈমানের অঙ্গ। বুখারি, হাদিস নং : ২৪।

উত্তম ব্যবহার ও অন্যকে সহযোগিতা করা:

জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা, ভালো কথা বলা ভদ্র ও মার্জিত রুচির পরিচায়ক। সদাচরণ মানুষকে কাছে টানে। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন– সচ্চরিত্র, উত্তম চাল-চলন এবং মধ্যমপন্থা অবলম্বন নবুয়্যতের পঁচিশ ভাগের একভাগ। আবু দাউদ। অর্থাৎ উত্তম চালচলন, মধ্যমপন্থা অবলম্বন এবং ধীরস্থির পদক্ষেপ ইত্যাদি হচ্ছে ইসলামি শিষ্টাচারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। তাই একজন মুসলমান তার অন্য মুসলিম ভাইকে সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করবে–এটা ইসলামের শিক্ষা।

যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন; যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমুহ দূর করবেন। বুখারি, হাদিস নং : ২৪৪২।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন