২২শে মার্চ, ২০২৫

পরিচালনা করবে সিটি কর্পোরেশন

দখলের ৮ বছর পর মহিউদ্দিন পরিবারের হাতছাড়া হচ্ছে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ এবং জমি, দুটোই দিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। অথচ, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে পারিবারিক সম্পত্তিতে রূপ দেয় চসিকের প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। আদালতের রায়ের তোয়াক্কা না করে প্রায় ৮ বছর বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিজেদের সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করেছে মহিউদ্দিনপুত্র সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তার পরিবার।

অবশেষে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবার প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। দখলের প্রায় ৮ বছর পর চসিকের নিয়ন্ত্রণে ফিরছে চট্টগ্রামের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।

প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন ভিসি, ট্রেজারার ও প্রক্টর। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এই তিন পদ শূন্য রয়েছে।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে এই আশঙ্কা থেকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের গঠিত কমিটির সঙ্গে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় উপস্থিত কমিটির সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে চসিকের অধীনে পরিচালনার প্রস্তাব সমর্থন করেন।

এ সময় মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, ২০০৩ সালেও চসিকের নিজস্ব ৪৭ কোটি টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৫০ লাখ টাকার প্রথম এফডিআরটাও আমাদের। ফেস বাই ফেস আমাদের কাছে সেগুলোর নোটিং আছে। তাই প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চসিকের সম্পত্তি, চট্টগ্রামের জনগণের সম্পত্তি। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে তাদের সুন্দর শিক্ষাজীবন নিশ্চিতে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চসিকের অধীনেই পরিচালিত হবে।

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বর্তমানে উচ্চ আদালতে দুটি মামলা চলছে। আইনি প্রক্রিয়াতেই প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় চসিকের নিয়ন্ত্রণে ফিরবে জানিয়ে তিনি বলেন, জালিয়াতির মাধ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে দখল করা হয়েছে। এজন্য প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে দখলমুক্ত করতে আইনের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি, ইউজিসির চেয়ারম্যানকে অবহিত করেছি, আইনজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছি। ভবিষ্যতে কোন মেয়র বা প্রভাবশালী যাতে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে জবরদখল না করতে পারে সে ব্যবস্থাও করা হবে। আমরা চাই প্রথমে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে চসিকের আওতাভুক্ত করে এরপর পর্যায়ক্রমে সংস্কারের কাজ পরিচালনা করবো।

যেভাবে শুরু হয় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়

চসিকের নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সংস্থাটির প্যাডে সরকারি দপ্তরে করা আবেদনের ভিত্তিতে ২০০২ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পায় সিটি করপোরেশন। বিশ্ববিদ্যালয়টি করার প্রস্তাব প্রথমে এসেছিল এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে। এরপর চসিকের মালিকানাধীন ভবনে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু করা হয়। শুরুতে চসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। পরে প্রবর্তক সিএসসিআর হাসপাতালের বিপরীতে এবং নগরীর ওয়াসা মোড়ের ফিলিং স্টেশনের উপরে সিটি করপোরেশনের দুটি জমিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করা হয়। জমি কেনা এবং তিনটি ভবন নির্মাণসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মোট ৪৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হয় সিটি কর্পোরেশনের তহবিল থেকে।

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। ফলে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন পদাধিকার বলে। ২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনে এম মনজুর আলমের কাছে পরাজয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদও হারান তিনি। তবে মেয়র মনজুর কর্পোরেশনের সাধারণ সভায় মহিউদ্দিনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টির সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন। ২০১৫ সালে আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব।

আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে মহিউদ্দীন চৌধুরীর আইনি লড়াই

২০১৫ সালের ১৪ জুলাই ইউজিসি এক চিঠির মাধ্যমে নতুন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীকে ট্রাস্টির চেয়ারম্যান হিসেবে উল্লখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ প্যানেলসহ ঘাটতি পদগুলো পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। পাশাপাশি সর্বশেষ ট্রাস্টি বোর্ড নিবন্ধন করা হয়নি জানিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে বলা হয়। এছাড়া একটি চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট (সিএ) প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের হিসাব নিরীক্ষা করতে বলা হয় ওই চিঠিতে।

চিঠিটির খবর চলে যায় এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে। তিনি ইউসিজির চিঠিটি কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা রেজিস্ট্রার বরাবর দেওয়া হলো না এই যুক্ত তুলে এবং বিশ^বিদ্যালয়ে চসিকের সম্পৃক্ততা ও হস্তক্ষেপ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এই যুক্তি তুলে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে উচ্চ আদালতের রিট পিটিশন দায়ের করেন।

আদালত রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে মহিউদ্দিনের অংশগ্রহণে কোনো ধরনের বাধা না দেয়ার নির্দেশনা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হিসেবে মহিউদ্দিন কেন ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে পারবেন না, তা জানতে চেয়েও রুল জারি করেছিলেন উচ্চ আদালত।

পরের বছর ২০১৬ সালের ১২ জুন দেওয়ানী আদালতে প্রতিকার চাওয়ার নির্দেশ দিয়ে মহিউদ্দিনের পিটিশন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। তবে ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অধ্যাদেশ, ১৯৮২ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২-এর কোনোটিতেই সিটি কর্পোরেশনকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে ওই মামলা চলাকালে চসিককে দেওয়া সেই চিঠিটি বাতিল করে ইউজিসি।

আদালতের পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশন রিভিউ পিটিশন দায়ের করে। ২০১৭ সালের মে মাসে রিভিউ পিটিশনের রায়ে উচ্চ আদালত উল্লেখ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ কোনো পক্ষের ওপর প্রয়োজ্য হবে না। এ রুলের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবার লিভ টু আপিল পিটিশন করেন মহিউদ্দিন। কিন্তু ওই বছর তার মৃত্যু হওয়ায় শুনানিতে হাজির হতে পারেননি। ফলে, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়রি লিভ টু আপিলটি খারিজ করে দেন আদালত। উচ্চ আদালতের মামলটি খারিজ হওয়ার পর দেওয়ানী আদালতেও কোনো মামলা করেননি মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের কেউ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনায় চসিকের সব ধরনের বাধা কেটে যায়। কিন্তু, মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে মহিউদ্দিনপুত্র নওফেল নতুন সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে পছন্দমতো ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেন।

রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নওফেলের জবরদখল

২০১৭ সালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি হন বড় ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এছাড়া দলীয় হাইকমান্ডের অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তৎকালীণ মেয়র আ জ ম নাছিল নাছির উদ্দীন। এর মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বনে যান নওফেল নিজেই।

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ১২ সদস্যের মধ্যে তিনজনই মহিউদ্দিন পরিবারের। বোর্ডের চেয়ারম্যান নওফেল, আর তার মা হাসিনা মহিউদ্দিন ও ছোট ভাই বোরহানুল হাসান চৌধুরী সদস্য হিসেবে আছেন। এর বাইরে ট্রাস্টি বোর্ডে ছিলেন এস আলম গ্রুপের তিনজন, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক অনুপম সেন, রেমন্ড আরেং, প্রকৌশলী শহীদুল আলম ও সাবেক সংসদ সদস্য সাবিহা মূসা।

২০১৯ সাল থেকে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এবং ২০২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী হলেও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েননি নওফেল। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়টি পারিবারিক ও রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার প্রভাবের কারণে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে ইউজিসি মতামত নেওয়া হতো না। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এককভাবে নওফেলের সিদ্ধান্তেই চলত বিশ্ববিদ্যালয়টি।

গণমাধ্যমকে ইউজিসির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরও নওফেল ট্রাস্টি চেয়ারম্যানের পদ না ছাড়ায় স্বার্থের সংঘাত দেখা দিয়েছিল। একইসঙ্গে তিনি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ছিলেন। এ কারণে জবাবদিহি নিশ্চিত হয়নি।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সনদ প্রাপ্তির জন্য নিষ্কণ্টক, দায়মুক্ত ও অখণ্ড জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা চসিকের জমি নিষ্কণ্টক ও দায়মুক্ত ছিল না। খণ্ড খণ্ড ক্যাম্পাস ছিল। এরপরও ২০২১ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে স্থায়ী সনদ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে।

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন