১৪ই মার্চ, ২০২৫

পাঁচলাইশের ল্যানসেট হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, ১২ লাখে সমঝোতা ২ চিকিৎসকের

শেয়ার করুন

চট্টগ্রাম শহরের বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা মুরাদ এস্কান্দর। দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর পিলখানা এলাকা তার শ^শুর বাড়ি। ওই এলাকার মিজানুর রহমানের মেয়ে খাদিজা বেগম সাকিকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে মিরাজ নামের প্রায় ৫ বয়সী একটি পুত্র সন্তান আছে। আর্থিক অনটন প্রায় লেগেই থাকতো তাদের সংসারে। এর মধ্যে কিছুদিন আগে কিডনিতে পাথর ধরা পড়ে। গত ১৬ নভেম্বর সেই পাথর অপসারণ করতে ল্যানসেট হাসপাতালে ডা. কামাল উদ্দিন মজুমদারের শরণাপন্ন হন মুরাদ। কিডনি অপারেশনও হয়। কিন্তু ওই দিন রাতেই তিনি মারা যান। এ সময় চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলেন ভুক্তভোগীর পরিবার। আর এই অভিযোগ থেকে বাঁচতে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে সমঝোতা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভুক্তভোগী রোগীর কিডনি থেকে পাথর বের করতে মূল অপারেশন করেন ডা. কামাল উদ্দিন মজুমদার এবং অপারেশনের আগে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট হিসেবে চিকিৎসা করেন ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরী আবির। এর মধ্যে ডা. কামাল উদ্দিন মজুমদার চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের চিকিৎসক এবং ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরী আবির একই হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের সাবেক মেডিক্যাল অফিসার। তারা দুজন ছাত্রজীবনে সম্প্রতি নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া ডা. কামাল উদ্দিন মজুমদার আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন চমেক হাসপাতাল শাখার সহ-সভাপতি।

সূত্রে জানা গেছে, এ দুই চিকিৎসক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে চিকিৎসার চেয়ে নানা তদবির ও টেন্ডারবাজিকে বেশ গুরুত্ব দিতেন। চিকিৎসক সমাজে দুজনের সম্পর্কে নানা দুর্নাম রয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তারা রাজনীতি ছেড়ে পুনরায় চিকিৎসা সেবায় মনোনিবেশ করেন।

১২ লাখ টাকার সমঝোতায় লিখিত আপসনামা হয়েছে। রোগীর স্বজনদের পক্ষে দুজন এবং অভিযুক্ত দুই চিকিৎসক স্বাক্ষর করেছেন। সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন আরও দুজন।

আপসনামায় উল্লেখ করা হয়, ১৬ নভেম্বর বিকেলে পাঁচলাইশ মডেল থানার অধীন ফজলুল কাদের রোডের মুরাদ এসকান্দরের (৪৫) কিডনির পাথর অপসারণে একটি অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়। এতে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন রাত সোয়া ৮টার দিকে রোগী মৃত্যুবরণ করেন। ল্যানসেট হসপিটাল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর সনদপত্রে ভিকটিমের মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘ ঝঁফফবহ ঈধৎফরধপ ধৎৎবংঃ রিঃয ওৎৎবাবৎংরনষব ঈধৎফরড় জবংঢ়রৎধঃড়ৎু ঋধরষঁৎব ’ উল্লেখ করেন। এটা একটি নিছক দুর্ঘটনা। তারপরও রোগীর একজন শিশু সন্তান থাকায় এবং ভিকটিমের স্ত্রী খাদিজা বেগম সাকি কম বয়স্ক হওয়ায় তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মানবিক কারণে উভয়পক্ষ একটি সমঝোতা করেন। সমঝোতা অনুযায়ী চিকিৎসকরা ভুক্তভোগীর সন্তান ও স্ত্রীকে ১২ লাখ টাকা প্রদান করবেন। এর মধ্যে ৬ লাখ টাকা ভুক্তভোগীর সন্তান মিরাজ মাশরাত এবং অবশিষ্ট ৬ লাখ টাকা ভুক্তভোগীর স্ত্রী খাদিজা বেগম সাকি পাবেন। এ ঘটনার বিষয়ে পরবর্তীতে কোনো পক্ষের আর কোনো আপত্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। উভয়পক্ষ ভুক্তভোগী রোগীর মৃত্যুর বিষয়ে থানায় কিংবা আদালতে কোনো প্রকার মামলা করতে পারবে না।

আপসনামায় রোগীর পক্ষে ছয় জনের নাম উল্লেখ করা হয়। তাদের মধ্যে মিজানুর রহমান ও আজিজুর রহমান নামে দুজন স্বাক্ষর করেন। চিকিৎসকদের পক্ষে অভিযুক্ত দুই চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করা হয় এবং সাক্ষী হিসেবে চুক্তিতে ডা. মিনহাজুর রহমান চৌধুরী এবং মোহাম্মদ জাবেদ হোসেন নামে দুজন স্বাক্ষর করেন।

ঘটনার বিষয়ে ভুক্তভোগী মুরাদ এসকান্দরের শ্বশুর মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ডাক্তারদের পুরোটাই অবহেলা ছিল। যেখানে অপারেশন করানো হয়েছিল সেখানে আইসিইউ নেই, অপারেশন থিয়েটারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নেই। শুনেছি সেখানে শুধু সিজার করা হয়। চিকিৎসকরা জেনেশুনে ওইখানে অপারেশন করিয়েছেন। ডাক্তাররা আমার মেয়ে জামাইটাকে অকালে মেরে ফেলেছে।
মামলা না করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ডাক্তারদের সমিতি আছে, তারা পয়সাওয়ালা। আমরা কিছু একটা করলে ডাক্তাররা উল্টো কিছু করতে পারে। এ কারণে আর মামলা করা হয়নি। তবে মেয়েরা কিছু খরচ পেয়েছে।

জানতে চাইলে অভিযুক্ত আরেক চিকিৎসক ডা. সালাউদ্দিন চৌধুরী আবির বলেন, ঘটনার পরপরই ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে রোগী পক্ষের শতাধিক লোক হাসপাতাল এলাকায় চলে আসে। পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে। কিন্তু ৮-১০ জন পুলিশের পক্ষে ওই মুহূর্তে এত লোক সামাল দেওয়া কঠিন। আমরা মব জাস্টিসের আশঙ্কা করছিলাম। ওইদিন সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা অনেকটা বাধ্য হয়েছিলাম। রোগী পক্ষকে আমরা ওই রাতেই ১২ লাখ টাকার চেক দিই। পরের দিন ১২ লাখ টাকা ক্যাশ নিয়ে উনারা চেক ফেরত দেন। বিষয়টি থানা পুলিশও অবহিত রয়েছে।

চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন, যদি রোগী পক্ষ অভিযোগ দেন আমরা তদন্ত করে দেখব এখানে চিকিৎসকদের আসলে কোনো গাফিলতি ছিল কি না। আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম রয়েছে, তারা যাচাই-বাছাই করবেন। এরপর তাদের মতামত সাপেক্ষে অর্থাৎ ভুল চিকিৎসার প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোলায়মান বলেন, উভয়পক্ষ এখানে এসেছিলেন। আমি রোগী পক্ষকে বলেছি যে, আপনারা অভিযোগ দিলে আমি মামলা নেব। আমি তো আর জোর করে নিজে থেকে মামলা নিতে পারি না। তখন রোগী পক্ষ আমাকে বলেছে, যে মারা গেছে মামলা করলে আমরা কী আর তার জীবন ফেরত পাব? বাচ্চাদের জন্য ওরা যে টাকাটা দিয়েছেন, এতেই আমরা খুশি।

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন