হাবিবুর রহমান এবং নাজমা আক্তার, তারা দুজন সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। ১০ বছর আগে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। তারা উভয়ই থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত বা থ্যালাসেমিয়া বাহক ছিলেন। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে ছোটো সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। কিন্তু বড় সন্তান পুরোপুরি সুস্থ। থ্যালাসেমিয়া এমন একটি রোগ, শিশু ও মা-বাবার কোন ভুল থেকে নয় বরং জিনগত কারণে সংঘটিত হয়।
এসব কথা বলছিলেন রোটারি ক্লাব অফ চিটাগং এরিস্টোক্রেটের পাস্ট প্রেসিডেন্ট থ্যালাসেমিয়া রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার জয়নাল আবেদীন মুহুরী।
তিনি আরও বলেন, থ্যালাসেমিয়ার বাহকে-বাহকে বিয়ে যখন হবে তখন তাদের চার জন সন্তানের মধ্যে অন্তত একজন থ্যালাসেমিয়া রোগী হতে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের দুটি সন্তানই থ্যালাসেমিয়ার রোগী হয়ে জন্ম নিতে পারে। থ্যালাসেমিয়ার বাহক যত বাড়বে, রোগীর সংখ্যা ততো বাড়বে।

আজ মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) চট্টগ্রাম নগরীর প্রবর্তক স্কুল অ্যান্ড কলেজে রোটারি ক্লাব অফ চিটাগং এরিস্টোক্রেটের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞান ক্লানের সার্বিক সহযোগিতায় থ্যালাসেমিয়া রোগের ওপর সচেতনতা বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ৩০০ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রভাষক মুক্তা দত্তের উপস্থাপনায় থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন ডাক্তার জয়নাল আবেদীন মুহুরী। এ সময় তিনি থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ, কিভাবে সংক্রমিত হয়, সুস্থ থাকার জন্য রোগীর কি কি করণীয় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
ডাক্তার মুহুরী তার বক্তব্যে বলেন, থ্যালাসেমিয়া হলো জন্মগত অর্থাৎ জেনেটিক রক্তরোগ। এটি রক্তশূন্যতা, যেটা জন্মগতভাবে এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। মানুষের শরীরের যেকোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য কমপক্ষে দুটি জিন দায়ী, যেটা ক্রোমোজোমের মধ্যে থাকে। শরীরের রং, চুলের রং, চোখের রং, শারীরিক গঠন এগুলো নির্ধারিত হয় জেনেটিকভাবে। থ্যালাসেমিয়াতে হিমোগ্লোবিন তৈরির হার কমে যায়। আর কতখানি কমবে তা নির্ভর করে একটি বা দুটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ কি না তার ওপর। রক্তের আরবিসি বা লৌহিত-রক্ত কণিকার মূল উপাদান হলো হিমোগ্লোবিন। এই হিমোগ্লোবিনই জীবনীশক্তি অক্সিজেন বহন করে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। হিমোগ্লোবিনের মধ্যে রয়েছে গ্লোবিন নামের প্রোটিন, যার রয়েছে দুটি আলফা ও দুটি বিটা গ্লোবিন চেইন। আলফা-জিন ও বিটা-জিন এই আলফা ও বিটা গ্লোবিন চেইনের পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে।
তিনি আরও বলেন, থ্যালাসেমিয়ার বেশ কিছু ধরন রয়েছে। এর মধ্যে হিমোগ্লোবিন-বিটা এবং হিমোগ্লোবিন-ই এই দুই ধরনের থ্যালাসেমিয়া বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৮ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৭% মানুষ থ্যালসেমিয়ার বাহক, এর মধ্যে ৪% বাহক-ই এবং ৩% বাহক-বি। কিন্তু দেশে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১০% থেকে ১২% মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ বাহক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। থ্যালাসেমিয়ার এই উচ্চ-প্রবণতার কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়- ১. থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা, ২. পারিবারিক বিয়ের প্রবণতা ও ৩. দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে।

থ্যালাসেমিয়া রোগ ধরা পড়লে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ডাক্তার মুহুরী বলেন, যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ, নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন ও সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা সুস্থ জীবন যাপন করতে পারেন।
সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন, রোটারি ইমিডিয়েট পাস্ট ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর ইঞ্জিনিয়ার মতিউর রহমান, রোটারি ক্লাব অফ চিটাগাং এরিস্টোক্রেটের প্রেসিডেন্ট রোটারিয়ান এস. এম. মুহিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট রোটারিয়ান নোমান বিন জহির উদ্দিন ও প্রবর্তক স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মনোজ কুমার দেব ।
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন রোটারি ক্লাব অফ আগ্রাবাদের পাস্ট প্রেসিডেন্ট রোটারিয়ান এস এস মো: কেরামাতুল আজিম, রোটারিয়ান মোহাম্মদ হাসান, কলেজ সেকশনের কোর্ডিনেটর মোহাম্মদ নুরুল হাসান, শিক্ষক সুপর্ণা চৌধুরী, মাহাবুবুল হাসান, আইরিন সুলতানা ও অভিভাবকবৃন্দ।
প্রবর্তক স্কুল এন্ড কলেজ এর সম্মানিত অধ্যক্ষ মনোজ কুমার দেব স্যারের অসাধারণ বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হন সবাই , এরই সাথে সাথে রোটারি ক্লাব অফ চিটাগাং এরিস্টোক্রেটকে ধন্যবাদ জানান এই ধরণের যোগপোযুগী একটি সেমিনার আয়োজনের জন্যে । পরিশেষে বিষেশজ্ঞ ডাক্তার জয়নাল আবেদীন মুহুরীর কুইজ এর মধ্যে দিয়ে এই সেমিনার এর সমাপ্তি ঘোষনা করা হয় ।