১৪ই মার্চ, ২০২৫

অর্ধলাখ অটোরিকাশা চালকের কপালে চিন্তার ভাঁজ

নিষিদ্ধ ঘোষণায় অটোরিকশা চালকদের মাথায় বাড়ি, কঠোর অবস্থানে সিএমপি

শেয়ার করুন

বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অলি-গলিসহ প্রধান সড়কগুলোতেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। যা চট্টগ্রাম নগরীর প্রধান সড়কগুলোতে যানজটের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব রিকশার চালকদের ভঙগি এমন, ছোট-বড় গাড়ি, বয়োবৃদ্ধ কিংবা শিশু, যেন কাউকেই তোয়াক্কা করার সময় নেই। এতে দুর্ঘটনার বাড়ছে প্রতিনিয়ত। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশবিহীন চট্টগ্রাম নগরীতে এদের দৌরাত্ম ব্যাপরোয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে, আজ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, আগামীকাল (সোমবার) থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে সব ধরনের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ থাকবে। আগেও এমন অনেক ঘোষণা এসেছিল, কিন্তু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম একেবারে বন্ধ হয়নি। তাই জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, আদৌ কী বন্ধ হচ্ছে?

হঠাৎ নিষেধাজ্ঞায় বিপাকে চালকরা :

অন্যদিকে, সিএমপির এমন নির্দেশনায় কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে অটোরিকশা চালক ও মালিকদের। চান্দগাঁও থানার পাঠানিয়াগোদা এলাকার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক কোরবান আলী বলেন, শহরের বাইরে খুব বেশি যাত্রী নেই। মালিক এবং চার্জ খরচও উঠে না। আমরা চলব কিভাবে? আমাদের পরিবার আছে। পরিবারকে কি খাওয়াবো?

ষাটোর্ধ্ব খলিলুর রহমান বলেন, অন্য কাজ করার মতো শক্তি নেই। গত ৫ বছর ধরে হালিশহর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাই। সেই আয়ে দুই সন্তানের পড়াশোনা এবং সংসার চলে। পুলিশের হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে প্রধান সড়কে চালাতে না পারলে সংসার চলবে কিভাবে, তা বুঝতে পারছি না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাকলিয়া এলাকার এক মালিক বলেন, এলাকায় রিকশার সংখ্যা অনেক বেশি, কিন্তু সেই পরিমাণ যাত্রী নেই। শহরের প্রধান সড়কগুলোতে চালালে ভালো যাত্রী পাওয়া যায়।

পুরো চট্টগ্রাম শহরে চলছে অর্ধলাখ অবৈধ অটোরিকশা 

প্রসঙ্গত, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অদৃশ্য কোন এক শক্তির বলে এসব গাড়ি দেদারছে চলছে চট্টগ্রাম মহানগরীতে। আর এ চলাচলকে আরও বেগবান করতে কয়েকটি সংগঠন মিলে গড়ে তোলা হয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে অবৈধ এসব গাড়ি চলতে দেয়া বাবদ নগরীতে প্রতিদিন চাঁদাবাজি হয় কোটি টাকার বেশি।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কোনো রকম সরকারি অনুমোদন ও রাজস্ব আদায় ছাড়াই চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। দৈনিক অটোরিকশা প্রতি ১০০-১৪০ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার এই চাঁদার পরিমাণ ১৭০-১৮০ টাকা।

জানা গেছে, নগরীর চান্দগাঁও, বাকলিয়া, বায়েজিদ, খুলশী, কোতোয়ালী, পাহাড়তলী, হালিশহর, আকবরশাহ থানা এলাকায় সবচেয়ে বেশি চলে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এর মধ্যে চান্দগাঁও থানাধীন মৌলভীবাজার থেকে কালুরঘাট ব্রিজ এবং ওয়াসা রোড, পাঠাইন্না গোদা থেকে হামিদচর, ওসমানিয়াপুল থেকে সিএন্ডবির আশেপাশের পুরো এলাকা মিলে ১০-১২ হাজার।

নগরীর হালিশহর ও পাহাড়তলী থানাধীন ফইল্যাতলী বাজার থেকে সবুজবাগ পেট্রোল পাম্পের মুখ, হালিশহর বি-ব্লক শাহজাহান বেকারির সামনে থেকে আশপাশের পুরো এলাকা, শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে সাগরপাড়, বণিকপাড়া হরি মন্দির, আইয়ুব খানের গ্যারেজ থেকে পাহাড়তলী থানা এলাকার সাগরিকা রোড, বেপারিপাড়া কাসেম কোম্পানির গ্যারেজ হয়ে আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকার ২৯টি সড়ক পর্যন্ত ১৫-১৬ হাজারের অধিক ব্যাটারি রিকশা চলাচল করছে। এর বাইরে নগরীর অন্যান্য এলাকাগুলোতে চলে আরও ৩০ হাজারের মতো।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম নগরে চলা ব্যাটারিচালিত রিকশায় দুই ধরনের ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর মধ্যে কিছু রিকশায় ১৩০ ভোল্টের এবং কিছু ২৩০ ভোল্টের ক্ষমতা সম্পন্ন।

সচেতন মহল কি বার্তা দিল :

এসব রিকশার জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয়। বিদ্যুৎ ঘাটতির সময়ে অবৈধ এই যানবাহন চলতে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত হচ্ছে না। এছাড়া বাহন নিরাপদও নয়। সাধারণ রিকশার অবকাঠামো কিছুটা পরিবর্তন করে তৈরি এসব রিকশা বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। এতে প্রায়ই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। রাজধানীতে প্রায় দুই লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। এগুলোর জন্য একদিকে যেমন বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে অদক্ষ চালক ও বেপরোয়া চলাচলের কারণে প্রায়ই হচ্ছে দুর্ঘটনা।

জানা গেছে, বেপরোয়া গতি এবং অদক্ষ চালকের কারণে গত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম নগরীতে অন্তত ২০ জনের মতো মানুষ মারা গেছেন। এর বাইরে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী-নাজিরহাট মহাসড়কের মিরেরহাট সংলগ্ন বড়ুয়াপাড়া এলাকায় প্রাইভেটকার ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে মো. রফিক (৬০) নামে এক বৃদ্ধ নিহত হন। গত ১৯ মার্চ উপজেলা সদরের বাসস্টেশন এলাকায় বেপরোয়া গতিতে আসা মোটরসাইকেলের সঙ্গে অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই যাত্রী আহত হন। ১৪ এপ্রিল ফটিকছড়ি উপজেলার ঝংকার মোড়ে রাস্তা পারাপারের সময় চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস লেগে আহত হন এক কলেজ ছাত্রী। ২৭ মার্চ নগরের চকবাজার প্যারেড কর্ণারে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায় অটোরিকশা চালক। এতে মোটরসাইকেলের পেছনের অংশ দুমড়ে মুচড়ে যায়। আহত হন মোটরসাইকেলে থাকা রিজভী ও তার ভাগিনা আব্দুল্লাহ। প্রায়ই এরকম দুর্ঘটনায় অনেকে হতাহত হলেও রিকশাগুলো বন্ধে কোন ব্যবস্থা নেই। এছাড়া, উঠতি বয়সী অদক্ষ চালকদের হাতে স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের হেনস্থা কিংবা ইভটিজিংয়েরও অভিযোগ আছে।

কি বলছে সিএমপি :

এদিকে, আজ রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টার দিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, চট্টগ্রাম নগরীর প্রধান সড়কগুলোতে আগামীকাল সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কাজী মো. তারেক আজিজ জানান, চট্টগ্রাম নগরের প্রধান সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশাসহ এই ধরনের সকল অবৈধ যানবাহন চলাচল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে। আগামীকাল (সোমবার) থেকে এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হবে।

তিনি আরও জানান, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে অবৈধ যানবাহন জব্দসহ নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে এই সংক্রান্তে সহায়তা করার জন্য নগরের সম্মানিত নাগরিকগণকে অনুরোধ করা হলো।

এর আগে গত মে মাসে তিনি একটি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, অবৈধ ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য বন্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। এক্ষেত্রে আমাদের নির্দেশনা হলো রাস্তায় এই গাড়ি দেখামাত্রই ধরা, জরিমানা করা। তবে এখানে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। জব্দ গাড়িগুলো রাখার মতো আমাদের পর্যাপ্ত জায়গা (ডাম্পিং প্লেস) নেই। ফলে গাড়ি ধরে জরিমানা করে একদিন পর ছেড়ে দেয়া হয়। যেদিন ধরে সেদিনও ছেড়ে দিতে হচ্ছে। যে কারণে মনে হচ্ছে চালকরা রাস্তায় এই অবৈধ গাড়ি নামানোর সাহস পাচ্ছে।

মহানগরনিউজ/এআই

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন