মনটা ভীষণ খারাপ। খারাপ থাকাই যেন নিয়তি, এ দেশে। এই একটা আশাব্যঞ্জক ঘটনা ঘটল তো দেখি তারপরই সেই ঘটনাকে ম্লান ক’রে দিয়েছে এক বা একাধিক দুঃখজনক বিষয়। আজ যে বিষয় নিয়ে কথা বলব তা নিয়ে প্রচুর জল (নাকি পানি?) ঘোলা হয়েছে; সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন ছাত্রীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার এবং তাদেরই একজনের ছাত্রত্ব ও সনদ বাতিলের ঘটনা।
এই কিছুদিন আগেও আমি কয়েকজনকে, এমনকি প্রশাসনের লোকজনকেও বলেছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আড়াই দশকের শিক্ষকতা জীবনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এতটা ছাত্রবান্ধব দেখিনি। বর্তমান ভিসি মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতারের মতো এমন কোনো ভিসি দেখিনি যিনি বিশেষত ছাত্র-কল্যাণে এত আন্তরিক, এত সাদামাঠা ও পরিশ্রমী। যিনি তাঁর লোকজন নিয়ে সকাল থেকে বেশ রাত অব্দি নানান সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও (এমন ভিসি কখনো দেখিনি যিনি বলেন, ৫ দিনের বই মেলায় কী হবে? ১৪ দিন বা তিন সপ্তাহের বইমেলা করেন!)।
কিন্তু তারপরেই ঘটল ছাত্রদের শাটল ট্রেনে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হাতে ইংরেজি বিভাগের দুই শিক্ষার্থীর মারাত্মভাবে আহত হওয়াকে কেন্দ্র ক’রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেনের মতো অত্যন্ত জরুরি একটি পরিবহন সেবায় যথাযথ নিরাপত্তার অভাবকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার মতো ঘটনা, যাতে তাদের প্রাণহানির মতো ভয়ংকর ঘটনাও ঘটে যেতে পারত। সেই ঘটনা নিয়ে ভিসি অফিসে অনুষ্ঠিত একটি সভায় বলেছিলাম যে, এই জন্যেই আমি কারো প্রশংসা করতে চাই না। প্রশংসা করার পরেই দেখি অবস্থার অবনতি ঘটে।
যাই হোক, সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অন্য ন্যাক্কারজনক ঘটনাটিতে ফিরি। সে ঘটনা সম্পর্কে আপনারা এরি মধ্যে ওয়াকিবহাল। ঘটনাটির ব্যাপারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর কথার পুনরাবৃত্তি হলেও কিছু কথা বলতে চাই:
১. একেবারে গোড়ার কথা হচ্ছে সেই হলের ছাত্রীরা হলের নাম পরিবর্তন বা ভাস্কর্যের ব্যাপারে প্রশাসনকে জানিয়েছিল। কিন্তু প্রশাসন সে-বিষয়ে উদ্যোগ নেয়নি। এখন তা ভাঙার দায়িত্ব কি ছাত্রদের? কোনো মবের? তারা সেই দায়িত্ববোধ দ্বারা তাড়িত হলে প্রশাসনকে প্রক্টরের অফিসে গিয়ে জানাতেই পারতেন; প্রশাসন তো ছাত্রবান্ধব, স্বৈরাচারের বিরোধিতায় আপসহীন। কিন্তু তা না ক’রে দল বেঁধে দিনে বা রাতে ছাত্রী হলে যাওয়াটা ছাত্রদের কতটা সমীচীন? তাও আবার ছাত্রী হলের গেটে তালা লাগিয়ে সে কাজে প্রবৃত্ত হওয়া? একবারেই না বলে আমার অভিমত। এই অনধিকার চর্চা করতে ছাত্ররা মেয়েদের হলটিতে না গেলে এসবের কিছুই ঘটত না।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকরাও নাকি সেখানে ছিলেন। তো, সাংবাদিকরা সেই সব ছাত্রদের বক্তব্য কতটা শোনার চেষ্টা করেছিলেন জানি না, কিন্তু ছাত্রীদের অভিযোগে জানা গেছে এত রাতে ভাস্কর্য ভাঙতে আসা ছাত্রদের দেখে হলের ছাত্রীরা তাদের কামরা থেকে ঘরের পোশাকেই বেরিয়ে এসে ছাত্রদের বাধা দেবার চেষ্টা করলে সাংবাদিকরা ছাত্রীদের ভিডিও তুলতে থাকেন।
এই কাজটি করা আমাদের সম্মানিত সাংবাদিকদের কতটা সঙ্গত হয়েছে? সাংবাদিকরা বা অন্য যে কেউ ছাত্রীদের ভিডিও ধারণ করতে লিপ্ত হলে তাঁদের নিবৃত্ত করতে ছাত্রীরা যদি সেল ফোন ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করেন সেটা কি খুব অযৌক্তিক?
৩. ছাত্রীদের উদ্দেশে প্রক্টরিয়য়াল বডির যে সদস্যদেরকে অত্যন্ত উত্তেজিত ভাষায় যেসব আপত্তিজনক ভাষা ব্যবহার করতে দেখা গেছে একাধিক ভিডিওতে তাতে আমরা অত্যন্ত আহত এবং মর্মাহত না হয়ে পারি না।
গত বছর ইংরেজি বিভাগের এম. এ. পরীক্ষায় ৩৯ জন শিক্ষার্থীর ফেল করা নিয়ে যে এক অভাবিত ও অরাজক ঘটনার সৃষ্টি হয় এবং ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ফেসবুকে ও কলাভবনসহ বিভিন্ন স্থানে যে প্রতিবাদ-সমাবেশ করে সেখানে ছাত্রদের ভাষা (বিভাগীয়) শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রায়ই শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গেলেও বিভাগের শিক্ষকরা তাদের প্রতি কোনো অশালীন আচরণ বা বাক্য প্রয়োগ করেননি। বরং মাথা ঠান্ডা রেখে যথেষ্ট বিচক্ষণতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় সে-সমস্যা নিরসন করেছেন।
৪. আমরা আরো মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ হয়েছি যখন প্রক্টরিয়াল বডির নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি ছাত্রী হলের ঘটনায় আন্দোলনরত ছাত্রী এবং এবং তাদের সমর্থক ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত আপত্তিজনক ভাষায় তাঁর ফেসবুক দেয়াল থেকে একটি স্ট্যাটাস দেন। (আমার মনে আছে, শাটল ট্রেনে দুই শিক্ষার্থীর ওপর আক্রমণের সেই ঘটনার পর ভিসি অফিসে অনুষ্ঠিত সেই মিটিং- এ আমি প্রক্টর মহোদয়কে বলেছিলাম আমি যেমন আপনাদের প্রশংসার যোগ্য কাজে প্রশংসা করব, এর উল্টো ঘটনায় আপনাদের সমালোচনায় করবো। তিনি সহাস্যে তাতে সম্মতি জানিয়েছিলেন।)
আজ দুঃখের সঙ্গে বলছি, আমি প্রক্টর মহোদয়ের আচরণের – যে আচরণটি তিনি এর আগেও তার কয়েকটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে করেছেন– আমি এখানে সেটার উচ্চকিত সমালোচনা করছি। তিনি ছাত্র-ছাত্রী নির্বিশেষে আমাদের শিক্ষার্থীদের হেয় করেছেন যা মোটেই কাম্য নয়। আমরা শিক্ষকরা সব সময় শিক্ষার্থীদের কাছে সম্মান প্রত্যাশা করি। কিন্তু ভুলে যাই, সম্মান না করলে কেবল পদাধিকার বলে সত্যিকারের সম্মান পাওয়া যায় না। আমাদের ছাত্রী এবং ছাত্ররা, অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ তাঁর এই আচরণে। তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। তিনি কী করবেন তা তিনি ভালো জানেন। তিনি বেশ দায়িত্ব নেবার পর কিছু কাজে বিচক্ষণতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সুনাম তিনি বোধহয় রক্ষা করতে পারছেন না।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, এবং একথা আমি অত্যন্ত জোরের সাথে বলতে চাই, ছাত্ররা খামোখা, এমনিতেই শিক্ষকদের প্রতি রুষ্ট হয় না, ক্ষুব্ধ হয়না। যথেষ্ট অবিচার, দুর্ব্যবহার, নিপীড়নের শিকার হবার পরেই কেবল তারা ফুঁসে ওঠে। তাদের সম্মান দিলে, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে, পুরো না হলেও এমনকি আংশিক ন্যায্য পাওনাটাও তাদের দিলে তারা প্রায় কখনোই শিক্ষকের সাথে খারাপ আচরণ করে না।
এই প্রসঙ্গে এই ঘটনার সবচাইতে আলোচিত অংশ, জনৈক ছাত্রীর হাতে প্রক্টরিয়য়াল বডির একজন সম্মানিত প্রফেসরের গায়ে হাত তোলা এবং সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক তার ছাত্রত্ব বাতিলই শুধু নয়, তার সনদপত্রও বাতিল করার মর্মন্তুদ বিষয়টি নিয়ে কথা না বললেই নয়।
এ-বিষয়ে তর্কের কোনো অবকাশ নেই যে সেই শিক্ষার্থী যে কাজটি করেছেন তা অত্যন্ত অন্যায় ও গর্হিত। শাস্তিযোগ্যও অবশ্যই। কিন্তু সেই সঙ্গে আমি আপনাদেরকে এ-প্রসঙ্গে সুচিত্রা সেন ও বিকাশ রায় রচিত, উত্তম কুমার প্রযোজিত ও অসিত সেন পরিচালিত “উত্তর ফাল্গুনী” (১৯৬৩) নামক একটি চলচ্চিত্রের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, যেখানে সুচিত্রা সেন যে চরিত্রে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন – তার নাম ভুলে গেছি, এবং উল্লেখ্য, ছবিতে সুচিত্রা সেনের ডাবল রোল, চরিত্রটির মেয়ের ভূমিকাতেও সুচিত্রা সেনই অভিনয় করেছেন – সে তার মদ্যপ স্বামীকে উত্তেজনার বশে, হিট অভ দ্য মোমেন্টে, নিদারুণ প্রোভোক্ড হয়ে গুলি ক’রে হত্যা করে। তাঁর ফাঁসীর আদেশ হয়। কিন্তু পরে সুচিত্রা সেনের পক্ষের উকিল যখন একথা প্রমাণে সক্ষম হন যে এই হত্যাটি সংঘটিত হয়েছে নিতান্তই ঘটনাক্রমে, এবং সুচিত্রা সেন যে কষ্ট করে ময়েকে বড় করেছে, এবং সেজন্য সমাজের চোখে অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ তাকে করতে হয়েছিল যা তার কন্যা জানত না, কিন্তু সুচিত্রার কাছে তার স্বামী মদের টাকা চাইতে এসে না পেয়ে কন্যাকে সেই গোপন কথাটি বলে দিতে চায় তখন সুচিত্রার পক্ষে তার মদ্যপ স্বামীকে নিরস্ত করতে তাকে হত্যা করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, তখন তার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়। এই সাথে স্মর্তব্য “Twelve angry men” ছবিটিও।
এখানেও, বিষয়টি বিবেচনায় নিতে বলি। এবং সেজন্য সম্প্রতি ফেসবুকের ভাষায় “ভাইরাল” হয়ে যাওয়া দু’তিনটে ভিডিও ক্লিপের কথা আমলে আনতে বলি সবাইকে।
অন্য যেসব ছাত্রীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের অনেকেই জুলাই আন্দোলনে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্ষানে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন জীবন বাজি রেখে, ফেসবুকে এবং বাস্তবে নানান ভয়ংকর হুমকি, ট্রল, ইত্যাদি উপেক্ষা ক’রে। কিন্তু সাম্প্রতিক এই ঘটনায় মজলুম হয়েও তাদেরকে সেই জুলাইয়ের জয়ী পক্ষেরই একাংশের হাতে নিদারুণ লাঞ্ছনার স্বীকার হতে হলো বাস্তবে, ফেসবুকে, এবং এখনো হচ্ছে, সম্মুখীন হতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন একটি অন্যায় সিদ্ধান্তের, যা মেনে নেয়া কষ্টকর। এবং বাংলাদেশের ছাত্র-ও শিক্ষক সমাজের একটি বড় ও অত্যন্ত সচেতন অংশ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার।বলছি না যে জুলাই অভ্যুত।সানে অংশ নিয়েছে বলেই কারো সাত খুন মাফ। কিন্তু একথা অবশ্যই বিবেবনার দাবি রাখে বলে মনে করি যে পুরো ঘটনার বিচারে তাদের সেদিন ক্ষু্ব্ধ হবার, উত্তেজিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমি এই বহিষ্কারাদেশের তীব্র প্রতিবাদ জানাই, ও তা বাতিলের দাবি জানাই।
শেষে একটা কথাই বলব, বাড়াবাড়ি, দম্ভ, জুলুম করে আমরা কী অর্জন করবো?
আমরা কি বার বার বিভিন্ন সরকার পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দলগুলোর পরিণতি দেখছি না? একটি দেশের স্বাধীনতা লাভের ৫৩/৫৪ বছর পরেও কি এমন অরাজক ও হতদরিদ্র অবস্থায় থাকার কথা? একটা, সিম্পলি একটা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে পারিনি আমরা যার ওপর এদেশের মানুষের শতভাগ আস্থা আছে, যা বিশ্বমানের!! আর তাছাড়া, কত খাবেন আপনি? কত-ধন সম্পদ অর্জন করবেন, বিশেষ ক’রে অন্যের হক মেরে? কী সম্মান অর্জন করবেন এভাবে? এক কানাকড়ি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন?
আর একটা কথা: আমাদের এত নারী বিদ্বেষ কেন? নারী দেখলেই আমরা হামলে পড়ি কেন? কেন অসম্মান জনক, অশালীন কোনো মন্তব্য বা কথা ছাড়া তাদের কথা আমরা ভাবতেই পারি না। একটা কথা আমরা ভুলে যাই আমাদের নিজের মা, বোন আর স্ত্রী কিন্তু অন্যের মা বোন স্ত্রী নন। তাঁরা নেহাতই নারী। ফলে, আমি অন্য নারীদের যে লালসার চোখে, অসম্মানের চোখে দেখছি, আমার পরিবারের নারীদেরকে অন্য পুরুষরা এই লালসা আর অসম্মানের চোখে দেখছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমরা বদলালে আমাদের পরস্পরেরই লাভ বা মঙ্গল।
শুধু ধর্মের ব্যাপারেই না, কোনো কিছুর ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি কখনো ভাল ফল বয়ে আনে না। হয়ত কিছু পয়েন্ট বাদ গেল। পুনশ্চ হিসেবে সেসব পরে যোগ করা যাবে হয়ত। এখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। আপাতত বিদায়।
লেখক : অধ্যাপক এবং বরেণ্য অনুবাদক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : আশা ও নিরাশার দোলাচল
শেয়ার করুন
মনটা ভীষণ খারাপ। খারাপ থাকাই যেন নিয়তি, এ দেশে। এই একটা আশাব্যঞ্জক ঘটনা ঘটল তো দেখি তারপরই সেই ঘটনাকে ম্লান ক’রে দিয়েছে এক বা একাধিক দুঃখজনক বিষয়। আজ যে বিষয় নিয়ে কথা বলব তা নিয়ে প্রচুর জল (নাকি পানি?) ঘোলা হয়েছে; সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন ছাত্রীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার এবং তাদেরই একজনের ছাত্রত্ব ও সনদ বাতিলের ঘটনা।
এই কিছুদিন আগেও আমি কয়েকজনকে, এমনকি প্রশাসনের লোকজনকেও বলেছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আড়াই দশকের শিক্ষকতা জীবনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এতটা ছাত্রবান্ধব দেখিনি। বর্তমান ভিসি মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতারের মতো এমন কোনো ভিসি দেখিনি যিনি বিশেষত ছাত্র-কল্যাণে এত আন্তরিক, এত সাদামাঠা ও পরিশ্রমী। যিনি তাঁর লোকজন নিয়ে সকাল থেকে বেশ রাত অব্দি নানান সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও (এমন ভিসি কখনো দেখিনি যিনি বলেন, ৫ দিনের বই মেলায় কী হবে? ১৪ দিন বা তিন সপ্তাহের বইমেলা করেন!)।
কিন্তু তারপরেই ঘটল ছাত্রদের শাটল ট্রেনে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হাতে ইংরেজি বিভাগের দুই শিক্ষার্থীর মারাত্মভাবে আহত হওয়াকে কেন্দ্র ক’রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেনের মতো অত্যন্ত জরুরি একটি পরিবহন সেবায় যথাযথ নিরাপত্তার অভাবকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার মতো ঘটনা, যাতে তাদের প্রাণহানির মতো ভয়ংকর ঘটনাও ঘটে যেতে পারত। সেই ঘটনা নিয়ে ভিসি অফিসে অনুষ্ঠিত একটি সভায় বলেছিলাম যে, এই জন্যেই আমি কারো প্রশংসা করতে চাই না। প্রশংসা করার পরেই দেখি অবস্থার অবনতি ঘটে।
যাই হোক, সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অন্য ন্যাক্কারজনক ঘটনাটিতে ফিরি। সে ঘটনা সম্পর্কে আপনারা এরি মধ্যে ওয়াকিবহাল। ঘটনাটির ব্যাপারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর কথার পুনরাবৃত্তি হলেও কিছু কথা বলতে চাই:
১. একেবারে গোড়ার কথা হচ্ছে সেই হলের ছাত্রীরা হলের নাম পরিবর্তন বা ভাস্কর্যের ব্যাপারে প্রশাসনকে জানিয়েছিল। কিন্তু প্রশাসন সে-বিষয়ে উদ্যোগ নেয়নি। এখন তা ভাঙার দায়িত্ব কি ছাত্রদের? কোনো মবের? তারা সেই দায়িত্ববোধ দ্বারা তাড়িত হলে প্রশাসনকে প্রক্টরের অফিসে গিয়ে জানাতেই পারতেন; প্রশাসন তো ছাত্রবান্ধব, স্বৈরাচারের বিরোধিতায় আপসহীন। কিন্তু তা না ক’রে দল বেঁধে দিনে বা রাতে ছাত্রী হলে যাওয়াটা ছাত্রদের কতটা সমীচীন? তাও আবার ছাত্রী হলের গেটে তালা লাগিয়ে সে কাজে প্রবৃত্ত হওয়া? একবারেই না বলে আমার অভিমত। এই অনধিকার চর্চা করতে ছাত্ররা মেয়েদের হলটিতে না গেলে এসবের কিছুই ঘটত না।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকরাও নাকি সেখানে ছিলেন। তো, সাংবাদিকরা সেই সব ছাত্রদের বক্তব্য কতটা শোনার চেষ্টা করেছিলেন জানি না, কিন্তু ছাত্রীদের অভিযোগে জানা গেছে এত রাতে ভাস্কর্য ভাঙতে আসা ছাত্রদের দেখে হলের ছাত্রীরা তাদের কামরা থেকে ঘরের পোশাকেই বেরিয়ে এসে ছাত্রদের বাধা দেবার চেষ্টা করলে সাংবাদিকরা ছাত্রীদের ভিডিও তুলতে থাকেন।
এই কাজটি করা আমাদের সম্মানিত সাংবাদিকদের কতটা সঙ্গত হয়েছে? সাংবাদিকরা বা অন্য যে কেউ ছাত্রীদের ভিডিও ধারণ করতে লিপ্ত হলে তাঁদের নিবৃত্ত করতে ছাত্রীরা যদি সেল ফোন ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করেন সেটা কি খুব অযৌক্তিক?
৩. ছাত্রীদের উদ্দেশে প্রক্টরিয়য়াল বডির যে সদস্যদেরকে অত্যন্ত উত্তেজিত ভাষায় যেসব আপত্তিজনক ভাষা ব্যবহার করতে দেখা গেছে একাধিক ভিডিওতে তাতে আমরা অত্যন্ত আহত এবং মর্মাহত না হয়ে পারি না।
গত বছর ইংরেজি বিভাগের এম. এ. পরীক্ষায় ৩৯ জন শিক্ষার্থীর ফেল করা নিয়ে যে এক অভাবিত ও অরাজক ঘটনার সৃষ্টি হয় এবং ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ফেসবুকে ও কলাভবনসহ বিভিন্ন স্থানে যে প্রতিবাদ-সমাবেশ করে সেখানে ছাত্রদের ভাষা (বিভাগীয়) শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রায়ই শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে গেলেও বিভাগের শিক্ষকরা তাদের প্রতি কোনো অশালীন আচরণ বা বাক্য প্রয়োগ করেননি। বরং মাথা ঠান্ডা রেখে যথেষ্ট বিচক্ষণতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় সে-সমস্যা নিরসন করেছেন।
৪. আমরা আরো মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ হয়েছি যখন প্রক্টরিয়াল বডির নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তি ছাত্রী হলের ঘটনায় আন্দোলনরত ছাত্রী এবং এবং তাদের সমর্থক ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত আপত্তিজনক ভাষায় তাঁর ফেসবুক দেয়াল থেকে একটি স্ট্যাটাস দেন। (আমার মনে আছে, শাটল ট্রেনে দুই শিক্ষার্থীর ওপর আক্রমণের সেই ঘটনার পর ভিসি অফিসে অনুষ্ঠিত সেই মিটিং- এ আমি প্রক্টর মহোদয়কে বলেছিলাম আমি যেমন আপনাদের প্রশংসার যোগ্য কাজে প্রশংসা করব, এর উল্টো ঘটনায় আপনাদের সমালোচনায় করবো। তিনি সহাস্যে তাতে সম্মতি জানিয়েছিলেন।)
আজ দুঃখের সঙ্গে বলছি, আমি প্রক্টর মহোদয়ের আচরণের – যে আচরণটি তিনি এর আগেও তার কয়েকটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে করেছেন– আমি এখানে সেটার উচ্চকিত সমালোচনা করছি। তিনি ছাত্র-ছাত্রী নির্বিশেষে আমাদের শিক্ষার্থীদের হেয় করেছেন যা মোটেই কাম্য নয়। আমরা শিক্ষকরা সব সময় শিক্ষার্থীদের কাছে সম্মান প্রত্যাশা করি। কিন্তু ভুলে যাই, সম্মান না করলে কেবল পদাধিকার বলে সত্যিকারের সম্মান পাওয়া যায় না। আমাদের ছাত্রী এবং ছাত্ররা, অত্যন্ত ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ তাঁর এই আচরণে। তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। তিনি কী করবেন তা তিনি ভালো জানেন। তিনি বেশ দায়িত্ব নেবার পর কিছু কাজে বিচক্ষণতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সুনাম তিনি বোধহয় রক্ষা করতে পারছেন না।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, এবং একথা আমি অত্যন্ত জোরের সাথে বলতে চাই, ছাত্ররা খামোখা, এমনিতেই শিক্ষকদের প্রতি রুষ্ট হয় না, ক্ষুব্ধ হয়না। যথেষ্ট অবিচার, দুর্ব্যবহার, নিপীড়নের শিকার হবার পরেই কেবল তারা ফুঁসে ওঠে। তাদের সম্মান দিলে, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে, পুরো না হলেও এমনকি আংশিক ন্যায্য পাওনাটাও তাদের দিলে তারা প্রায় কখনোই শিক্ষকের সাথে খারাপ আচরণ করে না।
এই প্রসঙ্গে এই ঘটনার সবচাইতে আলোচিত অংশ, জনৈক ছাত্রীর হাতে প্রক্টরিয়য়াল বডির একজন সম্মানিত প্রফেসরের গায়ে হাত তোলা এবং সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক তার ছাত্রত্ব বাতিলই শুধু নয়, তার সনদপত্রও বাতিল করার মর্মন্তুদ বিষয়টি নিয়ে কথা না বললেই নয়।
এ-বিষয়ে তর্কের কোনো অবকাশ নেই যে সেই শিক্ষার্থী যে কাজটি করেছেন তা অত্যন্ত অন্যায় ও গর্হিত। শাস্তিযোগ্যও অবশ্যই। কিন্তু সেই সঙ্গে আমি আপনাদেরকে এ-প্রসঙ্গে সুচিত্রা সেন ও বিকাশ রায় রচিত, উত্তম কুমার প্রযোজিত ও অসিত সেন পরিচালিত “উত্তর ফাল্গুনী” (১৯৬৩) নামক একটি চলচ্চিত্রের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, যেখানে সুচিত্রা সেন যে চরিত্রে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন – তার নাম ভুলে গেছি, এবং উল্লেখ্য, ছবিতে সুচিত্রা সেনের ডাবল রোল, চরিত্রটির মেয়ের ভূমিকাতেও সুচিত্রা সেনই অভিনয় করেছেন – সে তার মদ্যপ স্বামীকে উত্তেজনার বশে, হিট অভ দ্য মোমেন্টে, নিদারুণ প্রোভোক্ড হয়ে গুলি ক’রে হত্যা করে। তাঁর ফাঁসীর আদেশ হয়। কিন্তু পরে সুচিত্রা সেনের পক্ষের উকিল যখন একথা প্রমাণে সক্ষম হন যে এই হত্যাটি সংঘটিত হয়েছে নিতান্তই ঘটনাক্রমে, এবং সুচিত্রা সেন যে কষ্ট করে ময়েকে বড় করেছে, এবং সেজন্য সমাজের চোখে অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ তাকে করতে হয়েছিল যা তার কন্যা জানত না, কিন্তু সুচিত্রার কাছে তার স্বামী মদের টাকা চাইতে এসে না পেয়ে কন্যাকে সেই গোপন কথাটি বলে দিতে চায় তখন সুচিত্রার পক্ষে তার মদ্যপ স্বামীকে নিরস্ত করতে তাকে হত্যা করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, তখন তার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়। এই সাথে স্মর্তব্য “Twelve angry men” ছবিটিও।
এখানেও, বিষয়টি বিবেচনায় নিতে বলি। এবং সেজন্য সম্প্রতি ফেসবুকের ভাষায় “ভাইরাল” হয়ে যাওয়া দু’তিনটে ভিডিও ক্লিপের কথা আমলে আনতে বলি সবাইকে।
অন্য যেসব ছাত্রীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের অনেকেই জুলাই আন্দোলনে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্ষানে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন জীবন বাজি রেখে, ফেসবুকে এবং বাস্তবে নানান ভয়ংকর হুমকি, ট্রল, ইত্যাদি উপেক্ষা ক’রে। কিন্তু সাম্প্রতিক এই ঘটনায় মজলুম হয়েও তাদেরকে সেই জুলাইয়ের জয়ী পক্ষেরই একাংশের হাতে নিদারুণ লাঞ্ছনার স্বীকার হতে হলো বাস্তবে, ফেসবুকে, এবং এখনো হচ্ছে, সম্মুখীন হতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন একটি অন্যায় সিদ্ধান্তের, যা মেনে নেয়া কষ্টকর। এবং বাংলাদেশের ছাত্র-ও শিক্ষক সমাজের একটি বড় ও অত্যন্ত সচেতন অংশ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার।বলছি না যে জুলাই অভ্যুত।সানে অংশ নিয়েছে বলেই কারো সাত খুন মাফ। কিন্তু একথা অবশ্যই বিবেবনার দাবি রাখে বলে মনে করি যে পুরো ঘটনার বিচারে তাদের সেদিন ক্ষু্ব্ধ হবার, উত্তেজিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমি এই বহিষ্কারাদেশের তীব্র প্রতিবাদ জানাই, ও তা বাতিলের দাবি জানাই।
শেষে একটা কথাই বলব, বাড়াবাড়ি, দম্ভ, জুলুম করে আমরা কী অর্জন করবো?
আমরা কি বার বার বিভিন্ন সরকার পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দলগুলোর পরিণতি দেখছি না? একটি দেশের স্বাধীনতা লাভের ৫৩/৫৪ বছর পরেও কি এমন অরাজক ও হতদরিদ্র অবস্থায় থাকার কথা? একটা, সিম্পলি একটা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে পারিনি আমরা যার ওপর এদেশের মানুষের শতভাগ আস্থা আছে, যা বিশ্বমানের!! আর তাছাড়া, কত খাবেন আপনি? কত-ধন সম্পদ অর্জন করবেন, বিশেষ ক’রে অন্যের হক মেরে? কী সম্মান অর্জন করবেন এভাবে? এক কানাকড়ি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন?
আর একটা কথা: আমাদের এত নারী বিদ্বেষ কেন? নারী দেখলেই আমরা হামলে পড়ি কেন? কেন অসম্মান জনক, অশালীন কোনো মন্তব্য বা কথা ছাড়া তাদের কথা আমরা ভাবতেই পারি না। একটা কথা আমরা ভুলে যাই আমাদের নিজের মা, বোন আর স্ত্রী কিন্তু অন্যের মা বোন স্ত্রী নন। তাঁরা নেহাতই নারী। ফলে, আমি অন্য নারীদের যে লালসার চোখে, অসম্মানের চোখে দেখছি, আমার পরিবারের নারীদেরকে অন্য পুরুষরা এই লালসা আর অসম্মানের চোখে দেখছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমরা বদলালে আমাদের পরস্পরেরই লাভ বা মঙ্গল।
শুধু ধর্মের ব্যাপারেই না, কোনো কিছুর ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি কখনো ভাল ফল বয়ে আনে না। হয়ত কিছু পয়েন্ট বাদ গেল। পুনশ্চ হিসেবে সেসব পরে যোগ করা যাবে হয়ত। এখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। আপাতত বিদায়।
লেখক : অধ্যাপক এবং বরেণ্য অনুবাদক
শেয়ার করুন
আরও পড়ুন
ঢাবিতে ছাত্রশিবিরের ইফতারের সঙ্গে ৫০০ টাকা পেল শিক্ষার্থীরা
তারাবীহ নামায ও কিছু প্রশ্নের উত্তর
আবারও কর্মবিরতিতে গেল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা, রোগীদের সেবায় ব্যাঘাত
পাঁচ দফা আন্দোলনে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ইন্টার্ন চিকিৎকরা, অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’
দলীয় লিফলেট বিতরণের সময় ছাত্রদল নেতাকর্মীদের কলেজ থেকে বের করে দিল শিক্ষার্থীরা
শিক্ষক-সাংবাদিকদের লাঞ্ছনা— চবি শেখ হাসিনা হলের ১০ ছাত্রীকে বহিষ্কার