চট্টগ্রাম নগর জুড়ে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের মোট গ্রাহক সংযোগ রয়েছে ৬ লাখ ১ হাজার ৯১৪টি। এরমধ্যে গৃহস্থালি সংযোগ ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি।
চট্টগ্রাম নগরীর অক্সিজেন এলাকার বাসিন্দা মো. মনির হোসেন। থাকেন পরিবার-পরিজন নিয়েই। তার পৈতৃক বাড়িটি নির্মাণের সময় গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানীতে আবেদন করে পেয়েছিলেন মাত্র একটি চুলার সংযোগ। তবে সময়ের সাথে সাথে পরিবারের লোকসংখ্যা বাড়ায় মাত্র একটি চুলায় রান্না করতে হিমশিম খেতে হয় মনির হোসেনের স্ত্রী মুন্নি বেগমকে। বারংবার গ্যাস লাইন বর্ধিতকরণের আবেদন করেও পাননি এর কোনো সুরাহা। মনে আক্ষেপ নিয়ে মনির হোসেনের স্ত্রী মুন্নি বেগম বলেন, মাত্র একটি চুলা দিয়ে ছয় জনের রান্না বেশ সময় সাপেক্ষ। এরমধ্যে মাঝে মাঝেই কমে যায় গ্যাসের চাপ। সব মিলিয়ে এটি কোন দুর্ভোগের চাইতে কম নয়।
তিনি আরো যোগ করেন, আমাদের জানা মতে আরো শত শত লোক আছে যাদের কাছে একটি মাত্র গ্যাস সংযোগ আছে। বর্তমানে বহুতল ইমারত করেছন। তারা নিশ্চয়ই বৈধ সংযোগ না পেয়ে, অবৈধ সংযোগ দিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে!

এদিকে নগরীর বিআরটিসি এলাকার একজন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী মো. কামাল বলেন, এক বছর আগে গ্যাস লাইনের জন্য আবেদন করেছিলাম, তবে তা এখনো পাইনি। সিলিন্ডারের গ্যাসে খরচ অনেক বেশি পড়ছে, এতে লাভ তুলে আনতে অনেকটাই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমরা নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করেও গ্যাস পাচ্ছি না, আর অনেকেই আছেন যারা গ্যাসের অবৈধ সংযোগ নিয়ে দিব্যি ব্যবসা করে যাচ্ছেন। এই নিয়ে প্রশাসনের কোন নজনদারিও চোখে পড়ে না।
কয়েক বছর ধরেই দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে কমেছে উৎপাদনের হার। এক সময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন করা হলেও বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ২৩০ কোটি ঘনফুটের মতো। এই উৎপাদন হার আরো কমতে পারে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে নোঙর করা ভাসমান দুটি টার্মিনালের মাধ্যমে দিনে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা আছে।
এদিকে একের পর এক অভিযোগেও যেন হুশ ফিরছে না কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের। গ্রাহকরা নতুন সংযোগের জন্য বারংবার আবেদন করেও পাচ্ছে না গ্যাস লাইন। এরমধ্যে অবৈধ সংযোগে ছেয়ে গেছে পুরো চট্টগ্রাম নগরী। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেন কেজিডিসিএলের বেশকিছু অসাধু কর্মকর্তা।
এমন অবৈধ গ্যাস সংযোগ হরহামেশায় চোখে পড়ে নগরীর বিভিন্ন রেলওয়ে কলোনীগুলোতে। রেলওয়ের সরকারি কোয়ার্টারগুলোর আদলে গড়ে ওঠেছে একাধিক অবৈধ বসতঘর। এ সকল অবৈধ বসতঘরে রান্নার সুবিধা নিতে বৈধ গ্যাস সংযোগ থেকে দেয়া হয়েছে একাধিক অবৈধ গ্যাস সংযোগ। যার সবই নিয়ন্ত্রণ করে রেলওয়েতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর মোটা অংকের কমিশন যায় কেজিডিসিএলের অসাধু কর্মকর্তাদের পকেটে।
পাশাপাশি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনেও চলছে নানা অসঙ্গতি। প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন পেলেও ধীরগতির কারণে এখন পর্যন্ত মাত্র ৬০ হাজার ৫০০ মিটার বিতরণ করা হয়েছে। বাকি ৩৯ হাজার ৫০০ টি মিটার স্থাপনের জন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে আরো দুই বছর। এতে ব্যয় বাড়ে ৫০ কোটি টাকা। চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩২ কোটি ঘনফুট। ১ লাখ প্রিপেইড মিটার বসালে মাসে ১৫ লাখ ঘনমিটার গ্যাস সাশ্রয় হবে। এতে আর্থিক সাশ্রয় মাসে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা গ্রাহকদের প্রাপ্য সেবা দিতে সব সময় তৎপর। তবে কিছু জটিলতার কারণে আমরা খানিকটা পিছিয়ে আছি। তবে আশা করছি খুব দ্রুতই সকল সংকট কাটিয়ে জনগণের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবো।
এক প্রশ্নের জবাবে অবৈধ সংযোগের বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন আরো বলেন, অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে আমরা সব সময় অভিযান পরিচালনা করে আসছি। এই ব্যাপারে কোন ছাড় হবে না।
এই প্রেক্ষিতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভবন মালিক অভিযোগ করে বলেন, আগে ৫তলা ভবনের জন্য ১০টি লাইন থাকলেও নতুন বহুতল ভবন করার কারণে অতিরিক্ত সাইড কনেকশনের জন্য ২০ সংযোগ প্রয়োজন হয়। নিয়ম মতো টাকা জমা দিয়ে আবেদন করার পারও আইনি জটিলতা দেখিয়ে সংযোগ দেওয়া হয়নি। এর সুযোগ কিছু অসাধু কমর্তকর্তা গ্যাস সিলিন্ডারের আড়ালে অবৈধ লাইনের সংযোগ দিয়ে দেয়। যার কোন লাইন নেই তাকে অবৈধ সংযোগ দেওয়া সহজ নয়। কিন্তু যার একটি লাইন আছে সহজেই অবৈধ নিতে পারে। এর ফলে পুরনো লাইগুলোর আড়ালে অবৈধ সংযোগ বেড়ে গেছে ব্যাপক ভাবে।
এই সংযোগ গুলো বৈধ করা হলে গ্যাসের দাম না বাড়িয়েও সরকার বিপুল রাজস্ব বাড়াতে সক্ষম হতো বলে ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত।