চট্টগ্রাম শহরের কদমতলী পোড়া মসজিদ এলাকার বর্ণালী লুব্রিক্যান্টের মালিক শুভাশিষ (৬৫)। প্রতিদিনের মতো শনিবার দুপুরে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে দোকানে যান। গাড়ি থেকে নামতেই চারজন লোক দুই হাত ধরে টানাটানি করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে। দোকানের কর্মচারী বাধা দিলে সেই চারজন নিজেদের ডিবি পরিচয় দেন। তারা বলেন, শুভাশিষের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে। তাকে খুলশী থানায় নিয়ে যাচ্ছি।
গত শনিবার (৪ জানুয়ারি) চট্টগ্রামের শহরের সদরঘাট এলাকার কদমতলী পোড়া মসজিদ এলাকা থেকে ডিবি পরিচয়ে শুভাশিষকে তুলে নিয়ে গেছে সাদাপােশাকধারী চার জন। প্রথমে হাতে হ্যান্ডকাফ, পরে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় হাটহাজারী এলাকা, সেখানে দিনভর আটকে রাখা হয়। সন্দেহজনক বিষয় হচ্ছে, অপহৃত ব্যবসায়ীর রহস্য হচ্ছে- অপহৃত ব্যবসায়ীর স্বজনরা সদরঘাট থানায় যাওয়ার পরপরই বিষয়টি অপহরণকারীরা জেনে যায়।
পরে স্বজনরা সদরঘাট থানায় গেলে অপহরণকারীরা ওই ব্যবসায়ীকে প্রায় ১০ ঘণ্টা পর রাত ১০টার সময় ছেড়ে দেয়। তবে এ ঘটনায় সদরঘাট থানায় গতকাল রবিবার রাত ১০টা পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি কিংবা ঘটনায় জড়িত কেউ ধরা পড়েনি। একজন ব্যবসায়ীকে অপহরণ নিয়ে দিনভর নাটকীয় ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানেন না নগর পুলিশের ওই জোনের উপ-কমিশনারও (ডিসি)।

বিষয়টি জানতে সদরঘাট থানার ওসি রমিজ আহমদকে গতকাল রাত পৌনে নয়টার সময় মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। ওসি ফোন না ধরলেও নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) শাকিলা সোলতানা ফোন ধরেছেন। তিনি জানান, এ ধরনের কোন ঘটনা ওসি আমাকে জানাননি। বিষয়টি আমার জানা নেই।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অপহরণের শিকার শুভাশিষ বসু জানান, মাইক্রোবাসে তোলার পর আমার দুই হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেয়া হয়। একটি গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। গাড়িতে চালকসহ তারা চারজন ছিল। সবার মুখে দাড়ি ছিল। বয়স আনুমানিক ৩৫-৪০ বছর। গাড়ি চলতে চলতে তারা আমাকে বললো, তোর বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের পর মামলা হয়েছে। ওয়ারেন্ট আছে। তোকে খুলশী থানায় নিয়ে যাবো। যা বলার ওসি সাহেবের কাছে বলবি। কিন্তু তারা আমাকে খুলশী থানায় নেয়নি। প্রায় দুই ঘণ্টা গাড়ি চলার পর তারা আমাকে সিঁড়ি বেয়ে একটি রুমে ঢুকিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেয়। ওই রুমে দশটি প্লাস্টিকের চেয়ার থাকলেও তারা আমাকে মেঝেতে বসিয়ে রাখে। বিকেল তিনটার দিকে বাথরুমে যেতে চাইলে তারা একটি হাতকড়া খুলে দেয়।
শুভাশিষ জানান, তাদের কাছে আমি জানতে চাইলাম, তোমরা আমাকে কেন নিয়ে এসেছো? তখন তারা বললো, তোমাকে আমাদের চাহিদামতো মুক্তিপণ দিতে হবে। সন্ধ্যা সাতটার সময় আমাদের মেজর সাহেব আসবেন। তিনি কথা বলবেন। এর মধ্যে বিকেল আনুমানিক পাঁচটার দিকে যুবকদের একজন বললো, তোমার লোকজন সদরঘাট থানায় গেছে কেন? সদরঘাট থানা পুলিশ আমাদের গাড়ি চিনে গেছে। তোমার লোকজনকে থামাও। সদরঘাট থানায় আমার স্বজনদের যাবার বিষয়টি তারা কীভাবে জানলো বুঝতে পারিনি।
এই ব্যবসায়ী বলেন, সাড়ে পাঁচটার দিকে আরেকটি প্রাইভেটকার এসে থামে ওই ঘরের সামনে। তারা ঘরের সব বাতি বন্ধ করে দেয়। আমাকে আবার হ্যান্ডকাফ পরায় এবং গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ওই প্রাইভেটকারে উঠায়। প্রায় ৫০ মিনিট গাড়ি চালানোর পর আরেকটি ঘরে নেয়া হয়। তারা আমাকে বলে, তোমাকে ছেড়ে দেবো। তবে সদরঘাট থানা পুলিশকে থামাও। ছেড়ে দেয়ার পর মামলাও করতে পারবে না। মামলা করলে জানে মেরে ফেলবো। প্রায় দুই-তিন ঘণ্টা পর তারা আমাকে ওই প্রাইভেটকারে তুলে আমার মোবাইল ও চশমা ফেরত দেয়। রাত প্রায় দশটার সময় হাটহাজারী চৌধুরী হাট পার হয়ে সড়কের পাশে তারা আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। গাড়ি থেকে নামার পর আমার স্বজনদের ফোন দেই। তারা জানান, পুলিশ নিয়ে তারা অক্সিজেন এলাকা পর্যন্ত এসেছেন। পরে স্বজনরা এসে আমাকে চৌধুরী হাট এলাকা থেকে উদ্ধার করেন।
থানায় মামলা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে শুভাশিষ বলেন, আমাকে অপহরণের পর স্বজনরা সদরঘাট থানায় গিয়েছিলেন অভিযোগ জানাতে। রাতে উদ্ধার হওয়ার পর আমি সদরঘাট থানার ওসির কাছে গিয়েছিলাম। ওসি বলেন, আপনাদের একটু ভুলের কারণে অপহরণকারীদের ধরতে পারলাম না। তবে এ ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। অপহরণকারীরা আমার সাথে অমানবিক আচরণ করেছে। আমি মামলা করতে রাজি আছি।

এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর সদরঘাট থানার পশ্চিম মাদারবাড়ি এলাকার যুগীচাঁদ লেনের রামকৃষ্ণ ফার্মেসির মালিক রাজু মজকুরিকে ডিবি পরিচয়ে একই কায়দায় দোকান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পুলিশের এক কনস্টেবলসহ তিনজন হাতেনাতে ধরা পড়ে। ঘটনার নেতৃত্ব দেয়া কনস্টেবল ফাহাদ ইসলাম নগর পুলিশের পশ্চিম জোনের ডিসি হোসাইন মোহাম্মদ কবিরের অর্ডারলি ছিলেন।