১৫ই মার্চ, ২০২৫

কারাগারে বসে ষড়যন্ত্র, এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টার অভিযোগ কথিত বলৎকারকারীর বিরুদ্ধে

শেয়ার করুন

আনোয়ারার বাসিন্দা নুরুল আমিন (৫২)। পেশায় একজন রিকশাচালক। রিকশাচালিয়ে সংসার চালাতে না পেরে ১৩ বছর বসয়ী ছোট ছেলে নুরুল গণি মিজবাহকে বৈরাগ প্রাইমারী স্কুলের সামনে স্থানীয় আব্দুল আলিম তালুকদারের (৫৬) মালিকানাধীন ভবনে ইদ্রিসের মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ শিখতে পাঠাতেন। প্রায় এক বছর যাবত মিজবাহ প্রতিদিন নিয়মিত সেখানে কাজ শিখতে যেত। গত ১৪ অক্টোবর আব্দুল আলিম শিশু মিজবাহকে দিয়ে প্রথমে নিজের মোটরসাইকেলের ফ্লাগ পরিস্কার করিয়ে দুপুর ১২টার সময় মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় নিজের অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে যান। এ সময় আব্দুল আলিম তালুকদার শিশু মিজবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বলৎকার করে এবং এ ঘটনার কথা কাউকে বললে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন। পরে সে বাড়িতে ফিরে অসুস্থ বোধ করলে পরিবারের চাপে ঘটনার সবকিছু খুলে বলে। শিশু মিজবাহর পিতা অসহায় রিকশাচালক নুরুল আমিন আত্মীয়স্বজন এবং স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ নিয়ে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে শিশু মিজবাহর সঙ্গে অস্বাভাবিক যৌনাচার হয়েছে বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়। ঘটনার দুইদিন পর ১৬ অক্টোবর আব্দুল আলিমকে আসামি করে আনোয়ারা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা (মামলা নং- ১৩/১০) দায়ের করেন নুরুল আমিন। এদিন তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত আব্দুল আলিম তালুকদারকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে আনোয়ারা থানা পুলিশ। তিনি উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের মৃত আফাজ উল্লার ছেলে।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের সার্টিফিকেট

বলৎকারের শিকার হওয়া শিশু মিজবাহর বাবা নুরুল আমিন বলেন, অভিযুক্ত আব্দুল আলিম তালুকদার এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তি। আপোষ করতে আমাদের একটি আপোষনামাও পাঠিয়েছে। কিন্তু আমরা যথাযথ বিচারের দাবি জানানোতে অন্য একটি ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আমার পরিবারকে নিয়ে মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে ঘটনা ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। আমার ছেলের সঙ্গে হওয়া অপরাধের বিচারের জন্য শুরু থেকেই ওর (মিজবাহ) নানা ও মামা বিভিন্ন জায়গায় দৌঁড়াদৌড়ি করছে। এ খবর জানার পর তাদের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসায়ী এবং মাজার-মসজিদ দখলের চেষ্টার অভিযোগ তুলে ষড়যন্ত্র করে বেড়াচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযুক্ত আব্দুল আলিম তালুকদারের সঙ্গে স্থানীয় ইমাম হোসেনের সঙ্গে হযরত আলাউদ্দিন শাহ মাজার ও মসজিদ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিনের ঝামেলা চলছিল। এ নিয়ে তারা উভয়ে একে-অপরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইমাম হোসেন জানান, আব্দুল আলিম একসময় ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল এবং চিহ্নিত ভূমিদস্যু। এলাকার গরীব-অসহায় মানুষের জায়গা জমি দখল করে এখন কোটিপতি বনে গেছে। ২০১০ সাল থেকে হযরত আলাউদ্দিন শাহ মাজার ও মসজিদ দখল করে অবৈধ সভাপতি সেজে বসে আছে । গত ১৫ বছরে মানুষের দান করা কোটি কোটি টাকা অন্যত্র সরিয়ে নিজেরাই ভোগ করে যাচ্ছিল। প্রতিবাদ করায় আমাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে।

তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র মানুষের দান করা অর্থ ভোগ করছিল তাই নয়, মাজার ও মসজিদের জায়গার জাল দলিল বানিয়ে নিজেদের নামে করে ফেলারও চেষ্টা করেছিল। আমিসহ এলাকার সচেতনমহল বিষয়টি বুঝতে পেরে ২০২২ সালে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের পর ভূমিদস্যু আব্দুল আলিম ২২ দিন জেল হাজতে ছিল।

শিশু মিজবাহর নানা সাহাব মিয়া এবং মামা দেলোয়ারের ভূমিকা কী ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেলোয়ার মাজার এবং মসজিদ সম্পর্কিত বিষয়ে কোনোভাবেই জড়িত না। তার বাবা সাহাব মিয়া আমাদের মসজিদে একজন নিয়মিত মুসল্লি। এখানে তিনি প্রতিদিন পাঁচওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। মাজার এবং মসজিদের জাল দলিল নিয়ে আমি একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং ইসলামী ফাউন্ডেশনে। সেই অভিযোগের তদন্তকারী মুসল্লি সাহাব মিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলেন মুসল্লি ও অন্যান্য মানুষের দান করা দানবাক্সের অর্থ কে নিয়ে যান। তখন সাহাব মিয়া বলেছিলেন সভাপতি আব্দুল আলিম তালুকদারের নেতৃত্বে তার কমিটিতে থাকা অন্যান্যরা এখান থেকে বস্তাভরে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে গণনার কাজ করেন। এটাই তাদের অপরাধ।

শিশু মিজবাহর মামা দেলোয়ার বলেন, আমি কোনোভাবেই মাজার ও মসজিদ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে জড়িত না। আমার বাবা সেখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। তিনিও কোনো মামলা-হামলায় জড়িত না। আমার ভাগিনার সাথে ঘটা ঘৃণ্য ঘটনায় যথাযথ বিচারের দাবিতে আমি দৌঁড়াদৌঁড়ি করছি দেখে পূর্বশত্রুতার জেরে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিভিন্ন পত্রিকায় মিথ্যা সংবাদ ছাপানো হচ্ছে। আব্দুল আলিম গংরা এলাকায় আমাদের সম্মান নষ্ট করার জন্য এবং তার করা ঘৃণ্য অপরাধকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মূলত এই ষড়যন্ত্র করে বেড়াচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছে এমন একটি পত্রিকা দৈনিক বিজয় সংবাদ। আমি পত্রিকাটির সম্পাদকের কাছে সংবাদটির সত্যতা জানতে চাইলে তিনি আমার কাছে প্রতিবাদ ছাপানোর নামে টাকা দাবি করেন।

দৈনিক বিজয় সংবাদ ও অপরাধ তালাশ নামে দুইটি ভুঁইফোড় পোর্টালে ‘আনোয়ারা মিথ্যা অভিযোগে ব্যবসাীকে ফাঁসানোর খুশিতে মিষ্টি বিতরণ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আবার সেই সংবাদ বিভিন্নজনকে দিয়ে আনোয়ারার ফেসবুক ভিত্তিক কমিউনিটি গ্রুপগুলো শেয়ার করে যাচ্ছে ভুঁইফোড় পোর্টালগুলোর সঙ্গে জড়িতরা।

সংবাদটিতে দাবি করা হয়, আব্দুল আলিম তালুকদার হযরত আলাউদ্দিন শাহ মাজার ও মসজিদের বর্তমান সভাপতি। ইমাম হোসেন, সাহাব মিয়া ও দেলোয়াররা মিলে মাজার ও মসজিদ দখল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মিথ্যা মামলা ও নানাভাবে হয়রানি করে আব্দুল আলিম তালুকদারকে সরাতে না পেরে নিজের নাতীকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। এছাড়া, সাহাব মিয়া ও দেলোয়ারকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যদিও এ নিয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ বা আনোয়ারা থানা কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্যই সংযুক্ত করা হয়নি। শুধু তাই নয়, ইমাম হোসেন, সাহাব মিয়া কিংবা দেলোয়ার কারও কোনো বক্তব্য নেওয়া হয়নি।

আনোয়ারা থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইমাম হোসেন বাদে সাহাব মিয়া এবং দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ইয়াবা কিংবা ভূমিদস্যুতা নিয়ে মামলা থাকা তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। এলাকায় খোঁজখবর নিয়েও এ ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে পোর্টাল দুইটি তাদের বিরুদ্ধে এমন গুরুত্বর অভিযোগ তুলে তা প্রশ্নবিদ্ধ!

এ বিষয়ে জানতে দৈনিক বিজয় সংবাদের সম্পাদকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সংবাদ আমার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। আপনি যে দৈনিক বিজয় সংবাদ এর কথা বলছেন সেটা আমাদের না।’ এ সময় প্রতিবাদ ছাপানোর নামে টাকা দাবি করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। যদিও সম্পাদকের নাম জানতে চাইলে তিনি বলতে রাজি হননি। পত্রিকাটির অনলাইন পোর্টালে সম্পাদক ও প্রকাশকের নামের জায়গায় মো. বিজয় সরকার উল্লেখ আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাংবাদিকের নামে অপসাংবাদিকতা চর্চা করা এই চক্রটি আসল ‘দৈনিক বিজয় সংবাদ’ এর নামে হুবহু নাম রেখে একটি অনলাইন পোর্টাল খুলে। যেটির ডোমেইন নেম ডেইলি বিজয় সংবাদ ডট অনলাইন www.dailybijoysongbad.online)। আর অন্য দৈনিক বিজয় সংবাদ এর অনলাইন পোর্টালের ডোমেইন নেম ডেইলি বিজয় সংবাদ ডট কম www.dailybijoysongbad.com)।

দৈনিক বিজয় সংবাদের পুরো পোর্টাল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পোর্টালটিতে চট্টগ্রাম থেকে সংবাদ পাঠান এম এম মাঈনুদ্দীন নামের এক একজন। এই এস এম মাঈনুদ্দীনই অপরাধ তালাশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা চালান। তিনি এটির সম্পাদক। এছাড়া, দৈনিক আইনবার্তা নামের একটি জাতীয় পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান হিসেবেও নিজেকে পরিচয় দেন।

এ বিষয়ে জানতে এস এম মাঈনুদ্দীনকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।

আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনির হোসেন বলেন, বলৎকারের ঘটনায় প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে আমরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা রুজু করি এবং তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত আব্দুল আলিম তালুকদারকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করি। মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। আমরা বিস্তারিত তদন্ত করছি।

মহানগরনিউজ/এআই

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন