পার্বত্য খাগড়াছড়িতে আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোহেল রানা নামে এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করেছে শিক্ষার্থীরা। সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে পাহাড়ি এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল। এ ঘটনায় মামলাও হয়েছিল। কিন্তু, প্রমাণ না হওয়ায় সেই মামলা থেকে সোহেল রানা খালাস পান এবং চাকরিতে পুনরায় যোগ দেন।
যদিও এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি এবং কু-প্রস্তাব দেওয়ার এটাই প্রথম নয়। আগের কর্মস্থলেও ছাত্রীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলাসহ কু-প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ উঠে একাধিকবার এবং তা তদন্তে প্রমাণিতও হয়।। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আন্দোলনের মুখে দুইবার বদলি করা হয়।
সূত্রে জানা গেছে, সোহেল রানা ২০০৬ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের হোসেনাবাদ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন ও সেফটি বিভাগের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেই প্রতিষ্ঠানে তিনি ২০১১ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। কিন্তু এই সময়ে একাধিক ছাত্রীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলাসহ ছাত্রীদের মোবাইল ফোনে কু-প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১০ সালের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ওই প্রতিষ্ঠানের ২২ শিক্ষক-কর্মচারী সোহেল রানার বিরুদ্ধে রেজুলেশনে স্বাক্ষর করেন। পরে অভিযোগ সত্যপ্রমাণিত হওয়ায় পরের বছর শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের চাপের মুখে সোহেল রানাকে লক্ষ্মীপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে বদলি করা হয়। সেখানে কয়েক বছর শিক্ষকতা করে ২০১৭ সালে ফের হোসেনাবাদ টেকনিক্যালে বদলি হয়ে আসেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে আবারও পুরনো রূপে ফিরে যান সোহেল রানা।

ওই সূত্র আরো জানায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে হোসেনাবাদ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের কয়েকজন ছাত্রী আবারও তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও কু-প্রস্তাব দেওয়ায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। পরে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ। ওই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, তদন্ত কমিটি গড়িমশি শুরু করলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আবারও ক্ষেপে যান। পরিস্থিতি খারাপ দেখে পালিয়ে যান অভিযুক্ত শিক্ষক সোহেল রানা। পরে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় সেখান থেকে বদলি করে বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, সোহেল রানা খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন ও সেফটি বিভাগের চিফ ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে সোহেল রানার বিরুদ্ধে এক পাহাড়ি ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে মামলা হয়। ওই ছাত্রী আদালতে গিয়ে পাহাড়ি একটি সংগঠনের চাপে মামলা করেছে মর্মে সাক্ষ্য দিলে সোহেল রানা খালাস পান এবং চাকরিতে পুনরায় যোগ দেন। সোহেল রানা চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে পাহাড়ি ছাত্ররা তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির নানা অভিযোগ এনে প্রত্যাহার দাবি করে আসছিল।
আজ মঙ্গলবার আরেক শিক্ষার্থীকে জড়িয়ে একদল শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ করতে থাকে। দুপুরে সোহেল রানাকে অধ্যক্ষের রুমে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে তাকে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর জখম করা হয় এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রিপল বাপ্পি চাকমা বলেন, হাসপাতালে আনার আগে ওই ব্যক্তি মারা গেছেন। ময়নাতদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে। এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে, সোহেল রানার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। কোথাও কোথায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কায় জেলা প্রশাসন খাগড়াছড়ি জেলা সদর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
এ বিষয়ে জানতে খাগড়াছড়ির সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল বাতেন মৃধাকে ফোন করলে তিনি নিজেও আহত জানিয়ে ফোন কেটে দেন।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ইউএনও সুজন চন্দ্র রায় বলেন, ঘটনা সামাল দিতে গিয়ে আমি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন মাঠে রয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল জানান, ঘটনায় যারাই জড়িত; তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
মহানগর নিউজ/এআই