নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী সুপারিশ সংস্কার কমিশনের

শেয়ার করুন

নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিলো নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। ১৫টি মূল বিষয়সহ একটি বিশদ রিপোর্টে তারা মোট ৪৩৩টি সুপারিশ উল্লেখ করেছেন। এই সুপারিশগুলো শুধু আইনি সংস্কারে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রসূতি ছুটি, নিরাপদ অভিবাসন, কর্মসংস্থান, মজুরী ন্যায্যতা এবং নারীর সামগ্রিক উন্নয়নকে ঘিরে সাজানো হয়েছে।

শনিবার (১৯ এপ্রিল) বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন হস্তান্তর করে কমিশন।

প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে— সব খাতে নারী কর্মীদের জন্য ৬ মাস বা ২৪ সপ্তাহের পূর্ণ বেতনের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করা। শুধু তাই নয়, “প্রসূতি কল্যাণ” শব্দটি আইন থেকে বাদ দিয়ে “প্রসূতি অধিকার” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে এটি কোনো করুণা নয় বরং আইনগত অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। গর্ভধারণ থেকে প্রসবোত্তর ছুটির পুরো সময় চাকরিচ্যুতি নিষিদ্ধ করার কথাও বলা হয়েছে।

পাশাপাশি পুরুষদের জন্যও রয়েছে উদার সুপারিশ— সব খাতে ২ সপ্তাহের পিতৃত্বকালীন পূর্ণ বেতনের ছুটি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যেসব নারী শ্রমিক কাজ করছেন, তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে সুপারিশে। এটি নারীর কাজের মূল্যায়নের দিক থেকে বড় এক ধাপ। পাশাপাশি গণপরিবহনে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা প্রতিরোধে আইনগত ধারা সংযোজন ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

নারী অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মজীবন নিশ্চিত করতে, অভিবাসন আইন, বিধি ও নীতিমালায় সংশোধন এনে তাদের জন্য সর্বোচ্চ সুরক্ষা, সম্মান ও কল্যাণ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে অভিবাসী নারীদের সহায়তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এতে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা আরও জোরদার হবে এবং ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক করা হবে।

যেসব নারী অভিবাসন শেষে দেশে ফিরেছেন, তাদের পুনরায় সমাজে অন্তর্ভুক্ত ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে খসড়া পুনঃএকত্রীকরণ নীতি অনুমোদন ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে শুধু অন্তর্বর্তী সময় নয়, পরবর্তী সরকারের মেয়াদেও বাস্তবায়নযোগ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম— নারী ও পুরুষ উভয় শ্রমিকদের জন্য সমান ন্যূনতম মজুরী নির্ধারণ, যা বৈষম্য দূর করবে। এছাড়া প্রতি বছর ন্যূনতম মজুরী বিশ্বমান অনুযায়ী পুনর্মূল্যায়ন করার প্রস্তাব রয়েছে, যাতে সকল শ্রমিক বাঁচার মতো উপযুক্ত মজুরী পান।

প্রতিবেদনে নারীর উন্নয়ন সংক্রান্ত সুপারিশগুলো শুধু কর্মসংস্থান নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, সামাজিক সুরক্ষা, প্রশাসনে অংশগ্রহণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, গণমাধ্যমে উপস্থিতি, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তি— এই সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি সহিংসতামুক্ত, মর্যাদাপূর্ণ সমাজ গঠনের দিকেই এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় দেখা গেছে এই সুপারিশে।

সংবাদ সম্মেলনে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক জানান, আমরা মোট ৪৩৩টি সুপারিশ দিয়েছি। আমাদের মতে, যদি অন্তত ২০০টি বাস্তবায়ন হয়, তাহলেও নারীর অবস্থার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অগ্রগতি হবে। আমরা সুপারিশগুলোকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছি— ১. অন্তর্বর্তী সরকারের সময় যেগুলো সম্ভব, ২. ভবিষ্যৎ সরকারের মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য বিষয় এবং ৩. আর নারীর চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা ‘স্বাধীনতা’ অর্জনের জন্য যেসব স্বপ্ন আমরা দেখি।

তিনি আরও বলেন ২০২৫ সাল চলছে, এখনই সময়— নারীর অধিকার ও স্বপ্ন নিয়ে জাতীয় আলোচনার সূচনা হোক। বিতর্ক হোক, জানাজানি হোক, মানুষ জানুক নারীর স্বপ্নটা কী।

শেয়ার করুন

আরও পড়ুন