কুড়িগ্রামে পাসপোর্ট অফিসে জয়েন করার পর থেকে আমার অবস্থা হলো ইন্ডিয়ান টিভি সিরিজ ‘পঞ্চায়েত’ সচিব জি’র মতন।
পাসপোর্ট অফিসের ৩ তালায় আমার বাসা। ৩ বেডের ফুল ফার্নিশড একটা বাসা সরকার মহাশয় আমার জন্য ঠিক করে রেখেছেন। কী একটা অবস্থা। যেখানে থাকি, সেখানেই অফিস। ঘুম থেকে উঠে নিচে নেমে অফিস করি, দুপুরে উপরে উঠে ভাত খাই। আবার নামি। এভাবেই দিন চলে যায়।
কুড়িগ্রাম ছোট জায়গা। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সরকারি সব অফিস, সব জায়গায় খবর হয়ে গেছে নতুন এডি (পড়ুন সচিব জি) এসে গেছেন। একটু পর পর মানুষজন সাক্ষাৎ করতে আসেন।
কে আসেন? কে আসেন না? কলেজের শিক্ষক, স্কুলের শিক্ষক, সমন্বয়কের বাবা, সাংবাদিক ইত্যাদি। তা আজকে দু’জন সাংবাদিক আসলেন। আমার রুমের সামনের আন্সার তাঁদের ঢুকতে দিচ্ছিল না। আমি ভেতরে ঢোকালাম। তাঁরা বললেন, একটা সভা করবেন তাঁরা। এজন্য সহায়তা চান। আমি বললাম, কী ধরণের সহায়তা? তাঁরা বললেন, আর্থিক সহায়তা। আমি অবাক হয়ে বললাম, পাসপোর্ট অফিস কীভাবে আপনাদের আর্থিক সহায়তা করবে? তাঁরা বললেন, পাসপোর্ট অফিস না। আপনার কাছে চাচ্ছি।
আমি বললাম, ভাই আমার বেতন কত জানেন? ৩৩ হাজার টাকা। আমি কীভাবে আপনাদের সাহায্য করব? আর আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি ঘুষ খাই? এই কথা বলার পরে চলে গেলেন।

গতকাল আসলেন একজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের বাবা। অফিসে ঢুকে খুব রাগত স্বরে বললেন, আমি কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক অমুক এর বাবা। আমার সন্তানের পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়া হচ্ছেনা তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়া। এই যে দেখেন, সে সার্জিস, হাসনাতের বন্ধু। এখনই কিছু একটা করেন। মাথায় রক্ত উঠে গেলো। কেউ সমন্বয়কের অমুক, তমুক পরিচয় দিলে আমার মেজাজ বিগড়ে যায়। তবুও ঠাণ্ডা মাথায় বুঝালাম। না তিনি মানবেন ই না। অবশেষে, তিনি তাঁর সন্তানের সাথে আমাকে কথা বলায়ে দিলেন। সন্তান তখনো সার্জিস, হাসনাতের সাথে সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন। অগত্যা উপায় না পেয়ে নিজের আন্দোলন সম্পর্কিত পরিচয় বললাম। (উল্লেখ্য, সন্তান নিজেই বাবার আচরণের জন্য ক্ষমা চাচ্ছিল এবং আমার সাথে ভদ্র ব্যবহার করেছে)।
তো যাইহোক, এর মধ্যে আবার আরেক ঝামেলা, খাবো কী? আমার তো আর একজন প্রধান জি নাই যে তার বাসায় মাঝে মধ্যে দুই এক বেলা মেরে দেয়া যাবে। অগত্যা, একজন শেফ রাখলাম। রান্না ভালই, খারাপ না। তবে, এইখানে চুলায় ভাত চড়ানোর স্টাইল উল্টা। আগে পানি দেয়া হয়, পানি গরম হলে চাল। দেখে অনেকক্ষণ হাসলাম। এইখানে দুইটা বাজার। একটা সকালে জমে, আরেকটা জমে বিকালে। নদীর মাছ পাওয়া যায়। টাটকা মাছ। অরিজিনাল দেশী মুরগীও সহজলভ্য।
ভোজনরসিক হিসেবে আমার ইতোমধ্যেই জায়গাটা পছন্দ হয়ে গেছে। পাড়ার চায়ের দোকানদারের ছেলে বায়োজিদের সাথে পরিচয় হল। সে এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। মাঝে মাঝে আমি গেলে আমাকে লিকার কড়া, চিনি কম এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ায়।
কুড়িগ্রামের চা খুব ভাল। মাত্র ১০ টাকায় কড়া লিকারে গরুর খাঁটি দুধের সর সহ চা। আহা।
আমি বায়োজিদ মিয়াকে বললাম, সায়েন্সের জিনিসপাতি বুঝতে সমস্যা হলে আমার রুমে চলে আসবা। ভেবেছিলাম পাসপোর্টের এডি কীভাবে সায়েন্স বোঝাবে এই কথা ভেবে সে বিরক্ত হবে। কিন্তু দেখি, না। সে শুনে মহাখুশি। তার বয়সে আমি এই আমন্ত্রণ শুনলে বিরক্ত হতাম। দেশের নতুন প্রজন্ম কোন দিকে যাচ্ছে আসলে?
রাত ৯/১০ টা বাজলেই এখানে শুনশান নীরবতা। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়। এদিকে আবার কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এসে রাতে কলেজে ব্যাডমিন্টন খেলার আমন্ত্রণ দিয়ে গেলেন। ওখানে নাকি জেলার সব গণ্যমান্য ব্যক্তি খেলেন। খুব খুশি হলাম। খেলতে যেতে হবে।
লেখক : সহকারি পরিচালক, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, কুড়িগ্রাম।
কুড়িগ্রাম টেলস : পর্ব-১
শেয়ার করুন
কুড়িগ্রামে পাসপোর্ট অফিসে জয়েন করার পর থেকে আমার অবস্থা হলো ইন্ডিয়ান টিভি সিরিজ ‘পঞ্চায়েত’ সচিব জি’র মতন।
পাসপোর্ট অফিসের ৩ তালায় আমার বাসা। ৩ বেডের ফুল ফার্নিশড একটা বাসা সরকার মহাশয় আমার জন্য ঠিক করে রেখেছেন। কী একটা অবস্থা। যেখানে থাকি, সেখানেই অফিস। ঘুম থেকে উঠে নিচে নেমে অফিস করি, দুপুরে উপরে উঠে ভাত খাই। আবার নামি। এভাবেই দিন চলে যায়।
কুড়িগ্রাম ছোট জায়গা। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সরকারি সব অফিস, সব জায়গায় খবর হয়ে গেছে নতুন এডি (পড়ুন সচিব জি) এসে গেছেন। একটু পর পর মানুষজন সাক্ষাৎ করতে আসেন।
কে আসেন? কে আসেন না? কলেজের শিক্ষক, স্কুলের শিক্ষক, সমন্বয়কের বাবা, সাংবাদিক ইত্যাদি। তা আজকে দু’জন সাংবাদিক আসলেন। আমার রুমের সামনের আন্সার তাঁদের ঢুকতে দিচ্ছিল না। আমি ভেতরে ঢোকালাম। তাঁরা বললেন, একটা সভা করবেন তাঁরা। এজন্য সহায়তা চান। আমি বললাম, কী ধরণের সহায়তা? তাঁরা বললেন, আর্থিক সহায়তা। আমি অবাক হয়ে বললাম, পাসপোর্ট অফিস কীভাবে আপনাদের আর্থিক সহায়তা করবে? তাঁরা বললেন, পাসপোর্ট অফিস না। আপনার কাছে চাচ্ছি।
আমি বললাম, ভাই আমার বেতন কত জানেন? ৩৩ হাজার টাকা। আমি কীভাবে আপনাদের সাহায্য করব? আর আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি ঘুষ খাই? এই কথা বলার পরে চলে গেলেন।
গতকাল আসলেন একজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের বাবা। অফিসে ঢুকে খুব রাগত স্বরে বললেন, আমি কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক অমুক এর বাবা। আমার সন্তানের পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়া হচ্ছেনা তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়া। এই যে দেখেন, সে সার্জিস, হাসনাতের বন্ধু। এখনই কিছু একটা করেন। মাথায় রক্ত উঠে গেলো। কেউ সমন্বয়কের অমুক, তমুক পরিচয় দিলে আমার মেজাজ বিগড়ে যায়। তবুও ঠাণ্ডা মাথায় বুঝালাম। না তিনি মানবেন ই না। অবশেষে, তিনি তাঁর সন্তানের সাথে আমাকে কথা বলায়ে দিলেন। সন্তান তখনো সার্জিস, হাসনাতের সাথে সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন। অগত্যা উপায় না পেয়ে নিজের আন্দোলন সম্পর্কিত পরিচয় বললাম। (উল্লেখ্য, সন্তান নিজেই বাবার আচরণের জন্য ক্ষমা চাচ্ছিল এবং আমার সাথে ভদ্র ব্যবহার করেছে)।
তো যাইহোক, এর মধ্যে আবার আরেক ঝামেলা, খাবো কী? আমার তো আর একজন প্রধান জি নাই যে তার বাসায় মাঝে মধ্যে দুই এক বেলা মেরে দেয়া যাবে। অগত্যা, একজন শেফ রাখলাম। রান্না ভালই, খারাপ না। তবে, এইখানে চুলায় ভাত চড়ানোর স্টাইল উল্টা। আগে পানি দেয়া হয়, পানি গরম হলে চাল। দেখে অনেকক্ষণ হাসলাম। এইখানে দুইটা বাজার। একটা সকালে জমে, আরেকটা জমে বিকালে। নদীর মাছ পাওয়া যায়। টাটকা মাছ। অরিজিনাল দেশী মুরগীও সহজলভ্য।
ভোজনরসিক হিসেবে আমার ইতোমধ্যেই জায়গাটা পছন্দ হয়ে গেছে। পাড়ার চায়ের দোকানদারের ছেলে বায়োজিদের সাথে পরিচয় হল। সে এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। মাঝে মাঝে আমি গেলে আমাকে লিকার কড়া, চিনি কম এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ায়।
কুড়িগ্রামের চা খুব ভাল। মাত্র ১০ টাকায় কড়া লিকারে গরুর খাঁটি দুধের সর সহ চা। আহা।
আমি বায়োজিদ মিয়াকে বললাম, সায়েন্সের জিনিসপাতি বুঝতে সমস্যা হলে আমার রুমে চলে আসবা। ভেবেছিলাম পাসপোর্টের এডি কীভাবে সায়েন্স বোঝাবে এই কথা ভেবে সে বিরক্ত হবে। কিন্তু দেখি, না। সে শুনে মহাখুশি। তার বয়সে আমি এই আমন্ত্রণ শুনলে বিরক্ত হতাম। দেশের নতুন প্রজন্ম কোন দিকে যাচ্ছে আসলে?
রাত ৯/১০ টা বাজলেই এখানে শুনশান নীরবতা। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়। এদিকে আবার কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এসে রাতে কলেজে ব্যাডমিন্টন খেলার আমন্ত্রণ দিয়ে গেলেন। ওখানে নাকি জেলার সব গণ্যমান্য ব্যক্তি খেলেন। খুব খুশি হলাম। খেলতে যেতে হবে।
লেখক : সহকারি পরিচালক, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, কুড়িগ্রাম।
শেয়ার করুন
আরও পড়ুন
খুব শিগগির চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেন হবে : ধর্ম উপদেষ্টা
ড. ইউনূসকে ৫ বছর ক্ষমতায় চেয়ে পাগলা মসজিদে চিঠি
ফিলিস্তিনের জন্য বাংলাদেশি ৭ শিল্পীর প্রতিবাদী গান
৩৬ হাজার মেট্রিক টন চাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছালো ভারতীয় জাহাজ
সিইউএফএলে সার উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে মন্ত্রণালয়
খাগড়াছড়িতে ফুল বিজুতে ‘জার্নালিস্ট নট অ্যালাউড’ প্রতিবাদ, সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড়