একটি দেশের জাতীয় সংগীত সেই দেশ ও জাতির কাছে মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক। একটি জাতিকে মূলবোধ ও দেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ করা তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এবং রাষ্ট্রীয় আচারে জাতীয় সংগীতের পরিবেশন সেই দেশ ও জাতির প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। তাই, জাতীয় সংগীতের রয়েছে একটি আলাদা গুরুত্ব।
সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের হাতে গুমের শিকার হওয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আজমী তার গুমজীবনের বর্ণনা দেওয়ার জন্য একটি ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন। তখন সংবিধানের সঙ্গে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানান তিনি। মূলত, এরপরেই শুরু হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটির পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা।
তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি ও চেষ্টা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিকভাবেও প্রস্তাব করা হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা’কে বাদ দিয়ে অন্য কোনো গানকে নির্বাচিত করার।

জাতীয় সংগীত প্রথম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িত খন্দকার মুস্তাক আহমেদের সরকার। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর রাষ্ট্রপতির আসনে বসানো হয় খন্দরকার মুস্তাক আহমেদকে। ক্ষমতায় বসেই মুস্তাক জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দীন মোহাম্মদকে ওই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। ওই কমিটিকে বলা হয়, এক মাসের মধ্যে নতুন কোনো সংগীতকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রস্তাব করতে। এই বিষয়ে তিনটি বৈঠকের পর ওই কমিটি দুইটি গান থেকে একটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রস্তাব করে। গান দুটি হলো- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা। কিন্তু, ওই সময় ক্যু পাল্টা ক্যুতে এই প্রস্তাবের হালে আর পানি পড়েনি।
জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দ্বিতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিল। সেই সময় আমার সোনার বাংলাকে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার সোনার বাংলাদেশ’ গানটিকে প্রস্তাব করা হয়। সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউর রহমান। ওই সময়ের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে লেখেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতের জাতীয় সংগীত, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন, আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থি বিধায়, জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন আবশ্যক। ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’কে জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রস্তাব করেন।
প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও-টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে ‘প্রথম বাংলাদেশ’ গানটি প্রচারের নির্দেশনা জারি হয়। এই সময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি ‘প্রথম বাংলাদেশ’ গানটিও গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু, কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই উদ্যোগও থেমে যায়, পাথরে চাপা পড়ে সেই নির্দেশনাও।
জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তৃতীয় উদ্যোগ শুরু হয় ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রয়োজন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ওই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হক বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে সচিবের কাছে প্রেরণ করেন। সচিব জাতীয় সংগীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভুত বিষয় বলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে প্রেরণ করেন। একই বছরের ১৯ আগস্ট আবার প্রস্তাবটি সংস্কৃত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু সেই সরকারের আমলে প্রস্তাবটি আর গৃহীত হয়নি। এরপর এই সম্পর্কে আর তৎপরতা নথীতেও পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, জাতীয় সংগীত অপরিবর্তনীয় বলে কোনো আইন নেই। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। ২০০৬ সালে নেপালের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হয়। নাৎসিবাদকে উৎসাহিত করে এমন অভিযোগে জার্মানির জাতীয় সংগীতের কয়েকটি লাইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্ণবাদী শাসনের যুগ শেষ হলে ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সংগীতও পরিবর্তন করা হয়। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ২০০৪ সালে নতুন একটি সঙ্গীতকে সাময়িকভাবে নির্বাচিত করা হয়। যদিও তারা এখনও জাতীয় সঙ্গীত খুঁজছে। আফগান জাতীয় সঙ্গীত এখন পর্যন্ত কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথের লেখা আমার সোনার বাংলার প্রথম দশ লাইন জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। একই সঙ্গে দীজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’ গানটিকে জাতীয় গীত হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয় এবং এটিকেই জাতীয় সংগীত করার দাবি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে।
মহানগরনিউজ/এআই